রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানী আংকারায় তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এমন একটি ভোটে জয় উদযাপন করেন, যে ভোট তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেবে। এই গণভোটে জয়ী হয়েছেন একেপি দলের প্রধান ও দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোয়ান। তার নেতৃত্বাধীন হ্যাঁ পক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে; না ভোটের সঙ্গে ব্যবধান ছিল মাত্র ২ শতাংশ। এই ভোটের মধ্য দিয়ে তুর্কিরা দেশটির সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদও বাতিল হয়ে গেছে। বেড়েছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা।

প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম বলেছেন, এই গণভোটে কেউ হারেনি, কিন্তু একটি পক্ষ জয়ী হয়েছে: তুরস্ক ও তুরস্কের মহৎ মানুষেরা।

কিন্তু সামান্য ব্যবধানে এই জয় এবং এ নিয়ে বিরোধীদের বিক্ষোভ অন্য অর্থও জানান দেয়। দেশটির প্রধান দুই বিরোধী দল গণভোটের পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তুরস্কের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেকটাই সুষ্ঠু ছিল এই গণভোট। কিন্তু সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়টি রবিবার রাতের নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলেনি। বিরোধীরা জাল ব্যালট ও নির্বাচন কমিশনার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। বেশকিছু জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তারা ভোট পুনর্গণনার দাবি করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গণভোটে ‘জয়’ উদযাপন করছেন এরদোয়ান। তার দাবি, বেসরকারি ফলে আড়াই কোটি (৫১.৩৭ শতাংশ) ‘হ্যাঁ’ ভোট এসেছে। এর বিপরীতে প্রাপ্ত ‘না’ ভোটের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ (৪৮.৬৩ শতাংশ)। ইস্তানবুলে এক শোভাযাত্রায় ভোটগণনা শেষের খবর জানান এরদোয়ান। ৯৯.৪৫ শতাংশ ব্যালটই গণনা করা হয়েছে বলে দাবি তার। তবে এই জয়ের বিরোধিতা করছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল দ্য রিপাবলিকান পিপল পার্টি সিএইচপি। দলটি এই ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা ৬০ শতাংশ ভোটের পুনঃগণনার দাবি জানিয়েছে। তুরস্কের বড় তিন শহর ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরে ‘না’ ভোট পড়েছে বেশি।

‘হ্যাঁ’ ভোটের জয় বহাল থাকলে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হবে এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি হবে। তখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আওতায় চলে যাবে দেশটির গোটা আমলাতন্ত্র। এটি কার্যকর হবে ২০১৯ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পর। তখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পাঁচ বছর করে আরও দুই মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারবেন। সব মিলিয়ে আগামী একযুগ (২০২৯ সাল পর্যন্ত) তুরস্কের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন এরদোয়ান।

ডেলমা ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো সেলিম সাজাক বলেন, আজকের আগ পর্যন্ত তুর্কির সরকারবিরোধীরা মনে করত দেশটির নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কিন্তু যাই হোক, এটা পটপরিবর্তনকারী ঘটনা।

এরদোয়ানের সমালোচকরা বলছেন, সংবিধানের এই সংশোধনীর ফলে এক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ডি ফ্যাক্টো স্বৈরতন্ত্র কায়েম হবে। এরদোয়ানের সমর্থকদের যুক্তি, তুরস্কের অভ্যুত্থানের ইতিহাস, বিশেষ করে গত জুলাইয়ে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও জোট রাজনীতির ব্যর্থতার কারণে একজন শক্তিশালী নির্বাহী প্রয়োজন। নতুন এই ব্যবস্থা ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় থেকে কার্যকর হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনা হবে তা।

কিন্তু এখন কী ঘটবে? তুরস্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খুব সামান্য ব্যবধানে এরদোয়ানের এই জয়ের ফলে সব এরদোয়ানবিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। রবিবার রাতে ইস্তানবুলজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন তারা। এরদোয়ান হয়তো নিজেকে জয়ী দাবি করছেন, কিন্তু তিনি যে নিরঙ্কুশ বিজয় আশা করছিলেন তা লাভ করতে পারেননি।

যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর হিস্টোরিকাল অ্যানালাইসিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রিসার্চের আবাসিক ফেলো জিয়া মেরাল বলেন, স্বল্প ব্যবধান ও আপত্তিজনক ভোট এরদোয়ানের জয়কে ম্লান করে দেবে এবং পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেবে। এটা তুরস্কের সরকারবিরোধীদের শক্তিশালী করবে। তুরস্ক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও পরিবর্তনের দিকে না আগানোর জন্য উচ্চকণ্ঠ হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের বিবৃতিতে এরমধ্যেই তা দেখা গিয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক। সঙ্গে থাকবে বিক্ষোভ ও অনমনীয় রাজনৈতিক বিতর্ক।

এরদোয়ানপন্থী বলে পরিচিত তুর্কি দৈনিক সাবাহ-এর ওয়াশিংটন প্রতিনিধি র‌্যাজিপ সয়লু জানান, গত কয়েক বছর ধরে কুর্দিদের সশস্ত্র সংগ্রাম, ইসলামি স্টেটের (আইএস) ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা এবং গত বছরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে হ্যাঁ ভোটের জয়ী হওয়া। তিনি বলেন, আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এরদোয়ানের ব্যক্তিত্বেই মনোযোগী ছিল। তারা সামাজিক মেরুকরণ এবং গত চার বছর ধরে তুর্কি জনগণ যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন তা কম তুলে ধরেছে। এসব সংকট ও সমস্যা, কান্না ও দুর্ভোগে মানুষ স্থিতিশীলতা বেছে নিয়েছে। তারা এমন একটি ব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছেন যার ফলে তুর্কি সরকারের হাতে আরও নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা থাকবে, যা আমাদের পিছিয়ে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারবে। নতুন এই ব্যবস্থা প্রেসিডেন্টকে আরও শক্তিশালী করবে।

সেন্ট লরেন্স ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও মিডল ইস্ট ডেমোক্র্যাসি প্রকল্পের ফেলো হওয়ার্ড আইজেনস্ট্যাট মনে করছেন, যে ক্ষমতা এরদোয়ান পেয়েছেন তা যেস সংযত থাকে সেজন্য না শিবিরের কর্মসূচি থাকা দরকার। এটা না থাকলে এরদোয়ান হয়তো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠবেন। যদিও বিরোধীদের কথায় কান না-ও দিতে পারেন এরদোয়ান। তিনি বলেন, না শিবিরের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি) নেতাদের জেলে থাকা এবং সংবাদমাধ্যমে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পক্ষপাতমূলক প্রচারণার পরও তারা গণভোটে অনেক ভালো করেছে। স্বল্প ব্যবধানে হলেও এটা এরদোয়ানের জন্য জয়। বিরোধীদের দমাতে তিনি নিজের পদক্ষেপগুলো হয়তো শ্লথ করবেন না। এরদোয়ান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, হ্যাঁ ভোটের জয় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আসবে। আমি আশঙ্কা করছি, এ দুটির কোনোটাই সঠিক নয়।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ওমর তাসপিনার বলছেন, ইস্তানবুলসহ তুরস্কের তিনটি বড় শহরে হ্যাঁ ভোট পরাজিত হয়েছে। অথচ একসময় ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন এরদোয়ান। তাসপিনার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হচ্ছে ১৯৯৪ সালের পর প্রথমবারের মতো এরদোয়ান ইস্তানবুলে পরাজিত হয়েছেন। অনেক একেপি সমর্থকরাও তাকে ভোট দেননি। ভোটের ফলে দৃশ্যমান হয়, এরদোয়ানের বিরোধীরা একটি বিকল্প হয়ে সামনে আসতে পারে। তুর্কি গণতন্ত্রের জন্য বিরোধীদের মধ্যে বিভক্তি একটি ফোঁড়ার মতো। ফলে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে এগুতে পারে।

ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স ডেমোক্র্যাসিসের সিনিয়র ফেলো আয়কান এরদেমির এরদোয়ানের বিরোধীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে আশার প্রতিফলন দেখছেন। তিনি বলেন, এই গণভোটে কুর্দি ভোটারসহ সেক্যুলার তুর্কিরা ভোট দিয়েছে। এটি নতুন একটি যুগের সূচনা হতে পারে। কৌশলগত জোটের তুলনায় এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এরদোয়ানবিরোধীদের এখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতৃত্ব দরকার। মানুষ রয়েছে, মানুষের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। এখন কে এটাকে কাজে লাগাবে তা কোটি টাকার প্রশ্ন।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর তুর্কিশ স্টাডিজের পরিচালক গোনুল টল মনে করেন, এরদোয়ানের উচিত নতুন পথে আগানো। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনাও পুনরায় শুরু করা দরকার। তিনি বলেন, গণভোটের ফল দেখিয়ে দিয়েছে এরদোয়ানা যেভাবে চান সেভাবে জাতীয়তাবাদীদের পরিচালিত করতে পারবেন না। এ জন্য প্রয়োজন নতুন প্রবণতা। বিশেষ করে ২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্য এটা একান্ত প্রয়োজন। তুর্কি অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে হবে। এ ক্ষেত্রে কুর্দিদের সঙ্গে আলোচনায় ফেরাটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের চেয়ে এটা এরদোয়ানের জন্য সহজ হবে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’র তুর্কি বিশেষজ্ঞ ও এরদোয়ানকে নিয়ে একটি বইয়ের লেখক সোনের কাগাপ্তে মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার চেয়ে কম ব্যবধানে জয় এরদোয়ানের জন্য ভালো। তিনি বলেন, আমি মনে করি এটা সবচেয়ে ভালো ফল। যদি এরদোয়ান হেরে যেতেন তাহলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতো। অনেকেই এ আশঙ্কা করেছেন। আবার তিনি বড় ব্যবধানে জয়ী হলে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করতেন এবং সম্পূর্ণ স্বৈরাচারে পরিণত হতেন। কিন্তু এখন তার নিজেকে কিছুটা সংযত রাখতে হবে। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স।