আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ বেশি পড়লে কার্যত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন তিনি, আর ব্যালটে ‘না’ বেশি পড়লে সেটাকে তার বর্তমান পদে থাকার ওপরই জনগণের অনাস্থা হিসেবে ধরা হবে! তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিস্যেপ তায়্যিপ এরদোগানের ভাগ্য নির্ধারক এমন সাংবিধানিক গণভোটেই এখন সিল মারছে তার দেশের জনগণ। দিনশেষেই জানা যাবে এরদোগানের হাত ধরে তার প্রস্তাবিত ‘নতুন তুরস্ক’ চাইছে জনগণ, নাকি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক তুরস্ক’ই রক্ষা করতে চাইছে জনগণ।

প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর জন্য সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাবের পক্ষে আয়োজিত এ গণভোট শুরু হয়েছে স্থানীয় সময় রোববার (১৬ এপ্রিল) সকাল ৭টা থেকে। এই ভোট শেষ হবে বিকেল ৫টায়। এরপর গণনা শেষেই জানিয়ে দেওয়া হবে ভোট কি এরদোগানের পক্ষে গেল, নাকি বিপক্ষে।

জনগণের সিদ্ধান্ত পক্ষে বাগিয়ে আনতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও জনসেবা বাড়ানোর অনেক পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন এরদোগান। বলছেন তুরস্কের ‘আভিজাত্য ও ঐতিহ্য’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কথাও। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তিনি সাংবিধানিকভাবে কী প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, তা-ই সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় বেশি।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বলছে, এরদোগানের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়লে তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালনা সংসদীয় পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে চলে আসবে; রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হবেন প্রেসিডেন্ট- তিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখবেন; প্রধানমন্ত্রী পদবি বিলুপ্ত করে দুই বা ততোধিক ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ তৈরি করা হবে; প্রেসিডেন্টই নিয়োগ দেবেন মন্ত্রীদের; তার নেতৃত্বেই তৈরি হবে বাজেট; জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদেরও নিয়োগে থাকবে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা; প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে আইনও করতে পারবেন; তিনি একাই পারবেন জরুরি অবস্থা জারি করতে, এমনকি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে এবং প্রেসিডেন্টের বলয়ে থাকা মন্ত্রীদের ব্যাপারে পার্লামেন্ট আর স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারবে না।

সর্বময় ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে দিয়ে দেওয়ার এ প্রস্তাবে তাকে থামানোর সুযোগ রয়েছে একেবারেই কিয়দ। পার্লামেন্টে তিন ভাগের দুই ভাগ সদস্য এক হতে পারলেই কেবল প্রেসিডেন্টকে অভিশংসের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন। আবার প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের (প্রত্যেক মেয়াদ হবে পাঁচ বছর) বেশি ক্ষমতায় না থাকতে পারার সিদ্ধান্তও রয়েছে প্রস্তাবে।

২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে এ পদে আসীন হন এরদোগান। তুরস্কের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র সংসদীয় পদ্ধতিতে চলছে। এ পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করেছিলেন এরদোগান। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে তার প্রধানমন্ত্রী পদে আর না থাকার বাধ্যবাধকতা এসে যাওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে এখন সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা বর্তমান পদেই নিয়ে আসতে চাইছেন। সেজন্য তিনি তার ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট পার্টির (একেপি) মন্ত্রিপরিষদকে প্রভাবিত করে ডেকেছেন গণভোট। ক্ষমতার এই ‘এককেন্দ্রিকরণে’র দ্বন্দ্বে তার দলের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাবুতোগলু পদত্যাগ করেছেন বলে কথিত রয়েছে।

তবে রোববার ভোটের দিন সেসব আলোচনা ছাপিয়ে যাচ্ছে তার পক্ষে-বিপক্ষের কর্মীদের প্রচারণা। পক্ষের কর্মীরা প্রেসিডেন্টের আওড়ানো বুলিই বলছেন জনগণের দ্বারে দ্বারে, ‘নতুন এই পদ্ধতি আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতা ও নিরাপদ পরিবেশকে সংহত করবে। তুরস্কের পুরনো আভিজাত্য ও ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে।’

নিজের দল একেপি ছাড়াও এই গণভোট ডাকার ক্ষেত্রে এরদোগান সমর্থন পাচ্ছেন অন্যতম বৃহৎ দল ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টির (এমএইচপি)। গণভোটে এমএইচপির অবস্থানই বড় নীতি-নির্ধারণ করে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু মাঠে সক্রিয় এরদোগান বিরোধীরাও। তারা বলছেন, এই ভোটে ‘হ্যাঁ’ জিতে গেলে কোনো এক ব্যক্তি নজিরবিহীন ক্ষমতা পাবেন, সরকারের মধ্যে ক্ষমতার কোনো ভারসাম্য থাকবে না। বিরোধী শিবিরের নেতৃত্বে রয়েছে প্রধান বিরোধী দল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পতাকাবাহী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ও কুর্দি-সমর্থক পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)।

সিএইচপি-এইচডিপি মনে করে, এরদোগান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রাষ্ট্রে ইসলামী নিয়ম-নীতি বাস্তবায়ন করেছেন বা বাস্তবায়নের চেষ্ট‍া করেছেন। এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা বাগিয়ে নিতে পারলে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একটি ধর্মের নিয়ম-নীতি চাপিয়ে দিতে পারেন রাষ্ট্রের ওপর।

যদিও এ ধরনের অভিযোগের বিরোধিতা করে একেপির নেতারা বলে আসছেন, এরদোগান স্থানীয় ও আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রেখে আসছেন। তিনি বরাবরের মতোই তুরস্কের আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের ঝাণ্ডা সমুন্নত করার জন্য কাজ করে যাবেন। যে ‘আভিজাত্য বা ঐতিহ্য ফেরানো’র বুলিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আদলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলনের আকাঙ্ক্ষা বলে মনে করে বিরোধীরা।

ফলাফল কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোট গণনা পর্যন্ত। তার আগে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এই ভোটে এরদোগান নানাদিক বিবেচনায় এগিয়ে থাকছেন। তার মনোভাব কট্টর ও গোঁড়া বলেও প্রতীয়মান হলেও সম্প্রতি জনগণকে তার পক্ষেই দাঁড়াতে দেখা গেছে। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জিতলেন নজিরবিহীনভাবে। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পর গঠিত সরকারের জোট ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় পাঁচ মাসের মাথায় আরও বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং গত বছর সেনাঅভ্যুত্থান চেষ্টার সময় তার পক্ষে নেতাকর্মীদের মাঠ দখল এরদোগানের এগিয়ে থাকারই প্রমাণ দেয়।

তারপরও শেষটা দেখা যাবে ফলাফলে। দিনশেষে তুরস্কবাসী কী চাইলো! মন-মানসিকতায় একনায়ক হয়ে ওঠা এরদোগানের স্বপ্নের ‘নতুন তুরস্ক’, নাকি ‘ফিরিয়ে দাও মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক তুরস্ক’।