কাফি আনোয়ার
বৈশাখ যেনো রবিঠাকুরের আপাদমস্তক,নজরুলের বিদ্রোহী ঝাকঁড়াচুলের হিল্লোলিত বাংলা সংস্কৃতির মুখরিত কালভার্ট। কখনো জীবনানন্দের ধানসিঁড়ির তীর, কখনো রাখালীয়া সুরে নকশীকাথাঁর মাঠ। কখনোবা লালনের একতারার বাউলিয়ানা।

বৈশাখ প্রণয়াভিসারী উডু উডু মেঘের ঘাঘরা কিংবা অবারিত মাঠের প্রান্তছোঁয়া দিগন্তরেখায় বিরহমিলনের পার্শ্বচরিত্র। মিলনের মর্মন্তুদ ব্যাকুল পিয়াসী বিরহীযক্ষের মেঘদুত ,বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে উড়ে যাওয়া মেঘের জলবন্দনায় নত উপকুল।

যাপিতজীবনের শৃংখলিত গরাদে সুর্যের আসা যাওয়ার ফারাক নিমিত্তের সাকুল্য আলো-আধাঁরী। আর সময়ের জিপসী কাফেলায় কষ্টের জোনাকীরা শুধু জ্বলে আর নিভে যাপনের উপজীবিকায়। তবুও দিনযাপনের খেয়ায় কালের বৃত্ত থেকে একটি বিন্দু হৃদয়মনঅণূভুতির রন্ধ্রে নববর্ষের প্রভায় বিকশিত হয়। বিবর্ণ পানসে সময়ের রথে চড়ে আসে বৈশাখ, স্মৃতিবিস্মৃতির আস্তাঁকুড় থেকে কেঁপে কেঁপে উঠে কিছু সুখবিহবলতা। উন্মীলিত চোখে ছায়াচিত্রের ফ্যাশব্যাক হয়ে ভেসে আসে দুরন্ত কৈশোর, বিবস্ত্র স্মৃতির পুরানো জামা, ধান কাটা সারা বিস্তৃত মাঠে জেগে উঠা

দ্বীপের মত একখন্ড জমি, তারই মাঝে লোক ঐতিহ্য আর বৈশাখী মেলার নববারতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাখাপত্র সমেত একটি বাশেঁর ছোপ, রাখাল তার হাতের টিয়া তাড়ানো বাঁশের ঢাকটি ফেলে সদ্য ধরা ডুগডুগি,নাইলন সুতার লাটাই, কুমারের হাতের মৃৎশিল্পের নিপুঁণ আঁচড, রঙবেরঙয়ের ঘুড়ি, নাগরদোলা, পাতার বাঁশি।

সবই যেন নিস্তরঙ্গ হদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা মুগ্ধতা জাগানো সুপ্ত অণূভূতিতে চৈতন্যোদয়ের সাঁড়াশি প্লবতা, বাধাবন্ধনহীন মুক্ত হাওয়ার দমকা, প্রত্যাসন্ন বৈশাখের বেলোয়ারী আওয়াজ।

হুল্লোড়ঘেরা উচ্ছিষ্ট পৃথিবীর পঙ্কিল বাতাবরণের মাঝে মুখরিত জীবনে আনন্দের অমরাবতী হয়ে বৈশাখ এসে এঁকে দেয় সহজাত কবিতার ধুলিধুসর ক্যানভাস ।

নেই বাহুল্যতা, নেই উডকো শব্দের অতিঅলংকার। শুধু সৌন্দর্যের অনুপ্রাসে , ছন্দের নিক্কনে বেজে উঠে চিরায়ত বাংলার বিস্মৃত নুপুর।

বৈশাখ আমার স্বপ্নমগ্নতার অভিকেন্দ্রিক বলয়ে সঞ্জীবনী মন্ত্রের অনুরণন শুধু নয় ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অযাচিত প্রশ্নের ফোয়ারাও বটে।

কেনো বৈশাখের বৈশাখময়তার চক্রে বাংলার আবহমান হৃতসংস্কৃতি খোঁজার প্রগলভ উন্মাদনা ? কেনইবা জাত্য-বৈজাত্য ,আর্যঅনার্য, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির বিভাজিত ব্যবচ্ছেদে বিপন্ন আমাদের পিতৃপুরুষের কৃষ্টি ? কেনইবা বৈশাখ বরণের

বাতাসাপ্রসাদে বারুদের ঘ্রাণ সন্ত্রস্ত করে নাগরিক কোলাহল ? আজকের কবিরা কী ভুলে গেছে বৈশাখের বন্দনা , ঋতুবরণের নান্দীপাট ।

স্তুতিকীর্তনের মন্দিরা , সারিন্দা, খঞ্জরে বাজে না হারানো সেই সুর । বৈশাখ আসে যেন হৃত সংস্কৃতি খোঁজার প্রাণান্তপ্রয়াসে।

মৃৎশানকির পান্তাজলের নৈবেদ্যেই কী মিশে আছে আমাদের পিতৃপুরুষের হৃতসংস্কৃতির জটিল রসায়ন ? নতুবা কেন এই দিনেই শুধু নাগরিক প্রবাহে বাঙালিয়ানার প্রাহসনিক মঞ্চে আপাদমস্তক ক্লাউন সেজে নষ্টাজিয়ায় যাবর কেটে কেটে কালের আয়নায় নিজেকে খোঁজা ? মুখ ও মুখোশের মাঝখানে গৌবরের

সংস্কৃতিকে লুকিয়ে রাখার মাঝেই কী বৈশাখ আসে ?

কাল-মহাকালের আবর্তে কাবেরী থেকে ইরাবতী, জিব্রালটার থেকে ইউফ্রেটিস, হিমালয় থেকে সুন্দরবন, কৃষ্ণসাগর থেকে আন্দামান ভূগোলের পরতে পরতে আদিম আবাদে, পৌরাণিক ইতিহাসের পু-্রবর্ধন থেকে পলাশীর আম্রকানন অবদি ফসলী অভিষেকে নববর্ষ কিংবা নওরোজ কিংবা নেভরোজী আবাহনে বৈশাখ এসে জাগিয়ে দেয় প্রকৃতি, জাগিয়ে দেয় বাস্তুজগতের আনুষাঙ্গিক সংস্থান , রাঙিয়ে দিয়েছে নিসর্গের মদিরোন্মত্ত সৌন্দর্যের নান্দনিক পসরা।

পাতাঝরা দিনের শেষে , নীড়ে ফেরা সান্ধ্যপাখির কন্ঠে ধ্বণিত হচ্ছে বসন্তগান ।

পান্তাইলিশের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে উদ্বেলিত হচ্ছে অণূভূতির নিউক্লিয়াস , রসনার জৈবরসে সঞ্চালিত হচ্ছে বৈশাখের আমেজী স্বাদ ।

বৈশাখ এলেই আমের বোলে মোহিত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায় খুঁজে ফিরি শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিমোড়া হারানো সেই আম কাটার চাকু ,খুঁজি ফিরি সেই পোড়ামাটির ঘোড়া,বাতাসা প্রসাদ ,মুড়িমুড়কী,হাত ফস্কে পালানো লাটাইয়ের পিছনে পিছনে দৌড়াঁনো

পথ। দৌঁড়ে পালাচ্ছি ভরদুপুরে ঢিল ছোঁড়া অপরাধের শোচনা কাঁধে,দৌঁড়াচ্ছি রসনায় কামনার জল নিয়ে সিঁদুর আলতা পরা আমের পিছনে, দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মিশে গেছি

নাগরিক কোলাহলের নিরুদ্বেগ প্রবাহে। শৈশবের সেই চৈত্র সংক্রান্ত্রি , সূর্য্যি খেলা,বিউ-বৈসাবী উৎসবের প্রতীক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি,দাঁড়িয়ে আছি রমনাবটমুলে,ছায়ানটের মিছিলে কিংবা চারুকলার মঙ্গলশোভাযাত্রায়।

দাঁড়িয়ে থাকি শিহরিত উদ্বেগে, সন্ত্রস্ততায় কুঁকড়ে যাওয়া আনন্দবেদনার মাঝামাঝি, বেচেঁ থাকার আনন্দে। তবুও বৈশাখের নিষিক্ত প্রহরে ভুলে যাই দ্বন্দসংঘাতের অনাবশ্যকীয় সংকীণর্তার খিস্তিখেউড়। ভুলে যাই ত্রস্তস্মৃতির পদ্মপাতার জলছোঁয়া ফারাক।

বৈশাখ আসুক ছন্দের ঝঙ্কারে, খোকার বোলে, খুকীর তুলতুলে গালে। বৈশাখ আসুক প্রিয়সীর গ্রন্থিত আবেগে ঋদ্ধ সমোষ্ণ চুম্বনে । দোলায়িত স্পন্দনে, জীবনের জয়গানে। বাস্তবতার নির্জলা বাঙময়তায় হালখাতার পাতাগুলি ভরে থাক অনাগত অবশিষ্টে।

খোলে দাও জানালা, খোলে দাও হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। নৈঋতী হাওয়ায় ভেসে যাক জীর্ণ পথের হাপিত্যেশ, জরা গ্লাণি, ক্লেশ । নেমে এসো আজ অট্টালিকা ছেড়ে , পায়ে পায়ে ঘুঙুরের সুর তুলে , বৈশাখের নৈবেদ্যথালায় বর্ষবরনের উচ্ছ্বসিত আয়োজনে।

আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদস্পন্দনে তব, ভ্রমরগুঞ্জণে নব
পল্লবমর্মরে ।

শুভ নববর্ষ। শুভ কামনা থাকল সবার জন্য।