রহিম আব্দুর রহিম :

বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ। যার সাথে মিশে আছে ক্ষুধা-দারিদ্রতা, অভাব-অনটন, দু:খ- বেদনা, হাসি- কান্না, কৃষ্টি-কালচার, চিন্তা চেতনা এবং চাওয়া পাওয়ার বিশাল ফিরিস্তি। আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি? কি চেয়েছিলাম, কি পেয়েছি? বাংলা সন চালু এবং নববর্ষ পালনের নেপথ্যের ইতিহাস প্রমাণ করে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গৌরবময় বিশ্ববরেণ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দীক্ষা পেয়েছি। এই উৎসবের সূত্রপাত আজ থেকে ৫শ বছর আগে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। বাঙালি জাতির নতুন বছরের প্রথম দিনই পহেলা বৈশাখ। যেটি চালু করেন মোঘল সম্রাট আকবর। তিনি তার শাসনামলে ফসলের খাজনা তুলার সুবিধার্থে বাংলা বছরের হিসাব শুরু করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা নববর্ষ চালু হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৭ সালে ঢাকার রমনার বটমূলে। এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা ছায়ানট নামক সংগঠনের প্রাণ ড. সন্জিদা খাতুন। যে সংগঠনটি ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টানা ৪৯ বছর ধরে বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে। তবে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংগঠনটি রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান করতে পারেনি। এ ব্যাপারে, ড. সন্জিদা খাতুনের গত ২৮ চৈত্র ১৪২৩ বঙ্গাব্দ (১১এপ্রিল ২০১৭) খ্রিস্টাব্দে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান করতে না পারলেও তিনি তাঁর সাভারের বাড়ির মাটির ঘরে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গান-বাজনা করে দিবসটি পালন করেছি’। সব কিছু মিলেই বাঙালির বর্ষবরণে ৫০ বছর পূর্তি ১ বৈশাখ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ (১৪ এপ্রিল ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলা বর্ষবরণের মূলে ড. সন্জিদা খাতুনের চিন্তা ছিল ‘মানুষের মনের উৎকর্ষ সাধন’। যা তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেছেন। তাঁর চিন্তা-চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দানে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপ শুধু প্রশংসনীয় নয়, যা ইতিহাস বির্নিমানের ঐতিহাসিক অধ্যায়। বাংলা নববর্ষ উৎযাপনে তাঁর সরকারের বৈশাখী ভাতা চালু এবং দিবসটি পালনের রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা মোঘল সম্রাট আকবর, ড. সন্জিদা খাতুন এবং শেখ হাসিনার ইতিহাস অধ্যায়ের মেইল বন্ধনই বলা যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণা, দিবস পালনের নির্দেশনা নিয়ে যেমন আনন্দ উল্লাস রয়েছে, তেমনি বিতর্ক ও বৈষম্যের অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে বার বার। ‘সরকারি চাকুরীজীবীরা পাবে, বেসরকারিরা কেন পাচ্ছে না, কেন পাবে না?’ বৈশাখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতা প্রদানের ঘোষণা ঐতিহাসিক বটে। তবে এবারের বর্ষবরণের নেতিবাচক মাত্রা, বৈশাখী ভাতা না পাওয়ার আন্দোলন। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণাটি, সরকারিদের জন্য বেসরকারিদের জন্য নয় এমনটা ছিল না। কোন মন্ত্রী মিনিস্টার সংশ্লিষ্ট সচিবালয়ের সচিবগণ যা দেখাতে পারবেন না। ধারণা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার পরিচয়। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর দায়িত্ব এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দার উপর বর্তাচ্ছে। যা সময় হলেই বোঝা যাবে। অন্যথায় ড. সন্জিদা খাতুনের মন্তব্য ‘বাঙালিত্ব কি, জানে না রাষ্ট্র ও জনগণ’ এর দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। তবে হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা আর আমাদের ক্ষোভের কাছে বাঙালিত্ব আজ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভের কারণে আমরা বৈশাখ বরণ থেকে দূরে থাকতে পারি না। একইভাবে জনবান্ধব কোন সরকারও পারে না একদলকে ভাতা প্রদান করে অন্যদলকে বিমূখ করতে। সকল বিতর্কের অবসান তখনই ঘটবে, যখন সময়ের দাবী পূরণ হবে।

প্রধানমন্ত্রীর বৈশাখী ভাতা প্রদান ও বর্ষবরণ পালনের নির্দেশনায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহলের হাড়-হাড্ডির তাপমাত্রা এতই বেড়ে উঠেছে যে, তারা আর বিষয়টি সহ্য করতে পারছে না। শুরু হয়েছে কোরআন -হাদিসের অপব্যাখ্যা। বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ‘নববর্ষ ও কোরআন- হাদিসে অপব্যাখ্যা। অথচ বাংলা বর্ষ গননা শুরু হয়েছিল সাড়ে ৫শ বছর পূর্বে। বর্ষবরণ পালিত হচ্ছে মাত্র ৫০বছর ধরে। আর পবিত্র কোর-আন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৪শ বছর আগে। অথচ ধর্মান্ধ এই আলেমরা কিভাবে কোরআন হাসিদের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে! আমি নিজেও একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। যখন কোমলমতি শিশুরা প্রশ্ন করে বর্ষবরণ পালন কি জায়েজ? আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কোনআন হাদিসে এই দিবসটি পালন করতে মানা করা হয়েছে। তখন দু:খ হয়, আমরা কী সত্যিকার অর্থে কোরআন-হাদিস পড়ি কি না? এ আলেমদের দেয়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে সভ্যতার পরম যুগে জাতির চরম অবনতিই ঘটবে। তবে কি আমরা সেই তিমিরেই পড়ে আছি। যা ভাবতে হবে, প্রমাণ করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে।

ড. সন্জিদা খাতুন, জাতীয় পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেছেন, ‘দেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালিত্ব কাকে বলে জানে না। এমনকি রাষ্ট্রও সেটা জানে না। যে কারণেই গালে পতাকা, একতারা এঁকে বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করেন। মূল বিষয়টি অনুধাবনের চেয়ে যেখানে হৈহুল্লোর মূখ্য হয়ে উঠে।’ ড. সন্জিদা খাতুন শহরের বৈশাখ পালনের খন্ডচিত্র তুলে ধরে মন্তব্যটি করেছেন, তাঁর মন্তব্য যথার্থ। আমার কোমলমতি শিশু ছাত্রটির প্রশ্ন হয়তো এমনটাই ছিল যে, নববর্ষের নামে বেহায়াপনা কোরআন হাদিসে নেই অথবা ইসলাম সমর্থন করে না। হয়তো শিশুটিকে যা বুঝানো হয়েছে, শিশুটি তা বুঝতে পারেনি অথবা যিনি বুঝিয়েছেন তিনি বোঝাতে পারেনি। ড. সন্জিদার বর্ষবরণের অনুধাবন, আর বর্তমান বর্ষবরণের প্রামান্যচিত্র এক নয়। এক সময় নববর্ষ বরণ শুরু হতো দোকানপাটে হালখাতা, বাড়িঘর সাজানো-গোছানো, পুরোনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকে বরণ করা। আস্তে আস্তে এর পরিধি বাড়তে থাকে। বর্ষবরণ মানেই প্রানান্ত উৎসব প্রকৃতি। গ্রামে গ্রামে মেলা পার্বন। ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মই দৌড়, লাঠিখেলা, পাখি, হাডুডু খেলা, মৎস্য শিকারের মহোৎসব। মেলায় আসতে ঝুড়ি-মুড়ি, চুড়ি-মালা, মাটির থালা, বেতের পাটি, তালের পাখা, বাঁশের বাঁশি, কাঠের লাটিম, হরিণ-বাঘ, হাতি-ঘোড়া। কে-না বেচা হতো গজা, জিলাপী তিলের খাজা, চিনি সাজের ঘোড়া, আমিত্তি, রসগোল্লা। বিনোদনে পেতাম বায়োস্কোপ, পুতুল নাচ, মায়াপরি, নাগরদোলা, ঝুমুর যাত্রা ও যাত্রাপালা। সে কি শৈশবের বৈশাখ! এখানে ড. সন্জিদা খাতুনের অনুধাবনতো দূরের কথা বাঙালি চেতনার ধারে কাছেও নেই। নামমাত্র শোভাযাত্রা, বেহায়াপনা আর রং ছিটা-ছিটির মধ্যেই বৈশাখের কলঙ্ক প্রদর্শন হচ্ছে। শত আপদ বিপদ প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও আমরা বলিষ্ঠ কন্ঠে, দীপ্ত প্রত্যয়ে উচ্চারণ করতে পারি; সারা পৃথিবীর কোন দেশের আলাদা কোন বর্ষবরণ নেই। একমাত্র আমরা বাঙালিরাই পৃথক বর্ষবরণ করারমত উৎসবটি জাতিগতভাবে অর্জন করেছি। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, মুক্তির সংগ্রামে শতসহস্র লাখো মানুষ প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমাদের বৈশাখের চেতনা কি, আমরা করছি কি?। ড. সন্জিদা খাতুন তাঁর সাক্ষাৎকারের একাংশে বলেছেন, সংস্কৃতি মানুষের মনকে সুন্দর করে। এই সুন্দরবোধের সঙ্গে অবরাধের একটি বিরোধ আছে। ফলে সংস্কৃতিমান মানুষ অপরাধে জড়াতে পারে না।’ তার এই বক্তব্যের গবেষণালব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমরা গড়ে তুলতে পারি সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক ও মানব পাচারের মত জঘন্য অপরাধ চিরমুক্ত স্বদেশ। বিনির্মাণ করতে পারি, শিশু বান্ধব মানবতার স্বর্গরাজ্য সোনার বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে ড. সন্জিদা খাতুনের দর্শন অনুযায়ী ছোট ছোট দলে সংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছড়িয়ে দেয়া হোক দেশের পথে প্রান্তরে আনাচে-কানাচে।#

লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মোবাইল : ০১৭১৪২৫৪০৬৬

ই-মেইল: ৎধযরসধনফঁৎৎধযরস@যড়ঃসধরষ.পড়স