ভারত সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন, অমীমাংসিত তিস্তা ইস্যুর নিষ্পত্তির জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপরেই ভরসা রাখছেন, কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর নয়।

তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে মিস ব্যানার্জির দেওয়া বিকল্প প্রস্তাব যে তাকে হতচকিত করে দিয়েছে, শেখ হাসিনা সেটাও গোপন করেননি এবং বলেছেন ‘পানি চেয়ে আমি পেলাম বিদ্যুৎ’।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেও এই প্রস্তাব অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

যদিও মমতা ব্যানার্জির দল বলছে তাদের নেত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই দিয়েছেন।

সোমবার সকালে দিল্লির প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে থেকেই অবতারণা করেছিলেন তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ।

তিস্তা চুক্তি দ্রুত সই করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদি যে তার সরকারের দৃঢ় সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন, সে কথা বলেই লিখিত ইংরেজি বক্তৃতা থেকে শেখ হাসিনা সরে আসেন স্বতঃস্ফূর্ত হিন্দিতে।

মমতা ব্যানার্জিকে দিদিমণি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দিদিমণি কী করবেন তা তো আমি জানি না। ওনার সঙ্গেও কথা হয়েছে, উনি তো আবার নতুন কী একটা দেখিয়ে দিলেন।”

দিল্লিতে পাশাপাশি শেখ হাসিনা এবং মমতা ব্যানার্জি
দিল্লিতে পাশাপাশি শেখ হাসিনা এবং মমতা ব্যানার্জি

 

“কিন্তু মোদিজি তো আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ফলে আমরা অপেক্ষা করব কী হয় দেখার জন্য।”

তবে ‘দিদিমণি’র কাছে পানি চেয়ে তিনি যে অন্তত বিদ্যুৎ পেয়েছেন সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি শেখ হাসিনা।

হিন্দিতে শেখ হাসিনার এই ভাষণ দিল্লিতে তুমুল আলোড়ন ফেলেছে।

সেটা যতটা না ভাষার জন্য, তার চেয়েও বেশি বক্তব্যের জন্য।

তোর্সা-ধরলার মতো নদীগুলো থেকে তিস্তা অববাহিকায় পানি আনার যে প্রস্তাব দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তাকে ‘কী একটা নতুন জিনিস’ বলে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন এগুলোতে তার মোটেই সায় নেই। তিনি চান আগে চুক্তি হোক।

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্যর কথা থেকেও স্পষ্ট, মমতা ব্যানার্জির প্রস্তাব দিল্লিতেও একটা অস্বস্তি তৈরি করেছে।

জয়িতা ভট্টাচার্য বলছিলেন, “হুট করে এমন একটা প্রস্তাব – বিশদে গবেষণা বা স্টাডি না-করে কিছু বলা সম্ভব নয়। মমতা ব্যানার্জি হয়তো নিজে কিছু হোমওয়ার্ক করেই এমন কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা ভালভাবে না-জেনে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না এই প্রস্তাবটা আসলে কী!”

গোটা বিষয়টা তিস্তা নিয়ে আলোচনায় সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারা বা প্রেক্ষাপট যোগ করেছে বলেও তিনি মনে করছেন।

মমতা ব্যানার্জি যে তোর্সা নদীর জল ব্যবহার করার কথা বলেছেন তা প্রবাহিত হয়েছে কোচবিহার দিয়ে, আর ওই জেলাতেই তাঁর দলের বিধায়ক উদয়ন গুহ।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, অসম্ভব হলে নেত্রী এই প্রস্তাব দিতেন না বলেই তার বিশ্বাস।

“আমরা হয়তো রাজ্যের একটা অংশকে চিনি, কিন্তু তিনি গোটা বাংলাকে চেনেন। কাজেই মমতা ব্যানার্জি যখন বলেছেন, নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই বলেছেন, কিছু একটা পরিকল্পনা থেকেই বলেছেন”, বলছিলেন তিনি।

তবে ওই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে মি. গুহর অভিজ্ঞতাও কিন্তু বলে – তিস্তা বা তোর্সার মতো পাহাড়ি নদীগুলোতে জলের পরিমাণ কমবেশি হতেই থাকে এবং পাহাড়ে বৃষ্টির ওপর অনেকটা নির্ভর করে, জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সে বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে।

শেখ হাসিনার সফরের সময় দিল্লিতে আসতে রাজি হয়ে মমতা ব্যানার্জি তিস্তা চুক্তির পথকে প্রশস্ত করবেন, মাত্র তিন-চারদিন আগেও এমনটাই সবাই ভেবেছিলেন।

বাস্তবে দেখা গেল, আগে কখনও না-শোনা সম্পূর্ণ নতুন একটা আইডিয়া আলোচনার টেবিলে ফেলে তিস্তার বিষয়টিকে তিনি আরও জটিল ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললেন।

 

বিবিসি বাংলা