অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

প্রথমত পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমাদের মাঝে কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কেউ যদি বলেন মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির উৎস। তাহলে তিনি নির্ঘাত ভুলের স্বর্গে আছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা ৮০র দশকে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কিছু হিন্দু ছাত্রদের মৌনমিছিল। যাতে তখনকার সচেতন ছাত্র ছাত্রীসহ আপামর জনসাধারণ সমর্থন জানায়। কেননা বাংলাদেশি সচেতন, সম্প্রীতি প্রেমি প্রতিটি মানুষের চিরন্তন স্বভাব।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো , অনেকদিন বৃষ্টি না হলে আমরা হুজুরের মাধ্যমে দোয়া মাহফিলের ব্যবস্থা করি। কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন।তখন আমরা ধর্ম টেনে আনিনা। বৃষ্টি চাই। বৃষ্টি আমাদের প্রয়োজন । এতে সবাই মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করি। মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাপারে এমন একটি কিছু হয়েছিল। এখানে হিন্দু ছাত্ররা কি আচার পালন করেছে সেটা প্রাধান্য পায়নি হয়তো। প্রাধান্য পেয়েছে স্বৈরাচার এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে মৌন প্রতিবাদ আন্দোলন। পরবর্তীতে ৯০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীরা এই থিমটাকে মাথায় নিয়ে বৈশাখের শোভাযাত্রা চালু করে। এখানে তখনো কোন প্রতীকী ঘোড়া, বাঘ এর ছড়াছড়ি ছিলনা, ছিলনা হাজারো মানুষের ঢল। সুতরাং এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলা নিতান্ত ভুল ধারণা। এখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে উলঙ্গ বক্ষের নারীর প্রতিমা, দুর্গার বাহন প্যাঁচা,অশুর রাক্ষস, আর হাতী কোনোটাই থাকার কথা নয়। মনে হয় এরশাদ বিরোধী মঙ্গল শোভাযাত্রা এসে লাগলো আনন্দ শোভাযাত্রায়।এরকম বাঙালি কৃস্টির মধ্যে অনেক আছে যেমন, হালখাতা, হাল ফেলানী ইত্যাদি। এসবকে মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে তাল গোল পাকিয়ে ফেললে তো হবেনা। আপত্তি আসতে লাগলো বিভিন্ন মহল থেকে । তবু থেমে থাকেনি এই শোভা যাত্রা। এটিকে বৈশাখের একটি উপাদান ভাবতে শুরু করলো সবাই। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কোনটি ছিলনা এটি। ক্রমাগত মঙ্গল শোভাযাত্রা আর পহেলা বৈশাখ একই সূত্রে গ্রথিতহলো। পরবর্তীতে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার থিমটাকে নিয়ে বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু করে।অবশ্য হাতী ঘোড়ার বাঘ ইত্যাদির প্রতীকী ছড়াছড়ি তখন ছিলনা।তাই এই মঙ্গলশোভাযাত্রাকে বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত।

একুশ শতকের প্রথম দিকেওতো বর্ষ বরণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা । এসব কে নাজানে। এরশাদ বিরোধী সেই মঙ্গল প্রার্থনা এসে লাগলো মঙ্গল শোভাযাত্রায়।এসব মঙ্গল শোভাযাত্রায় কুৎসিত কিছু ঘটনাও ঘটেছে। আমি দেখেছি মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছেলে মেয়েদের যে যুগলবন্দির কাজ চলে।বেশ কবছর আগে ইমরান এইচ সরকারের বিজয় মঞ্চের কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার সহধর্মিনীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলা। আমার ছেলে আমার সাথে গাড়ি না পেয়ে সেই বিজয় মঞ্চের কাছে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এখানে ছেলে মেয়েদের যে অবস্থা দেখলামতা বলার নয় । ছেলেকে বললাম তুমি এপথ দিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছো কেনো। সে বললো বাবাগাড়ী নেই।সে ঢাকায় ব্রেক ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে।তাই বলছিলামকি মিডিয়ামেনরা বর্ষবরণে এসব নোংরামি,শ্লীলতাহানি অন্য দলের ঘাড়ে চাপালেও আদৌ তা নিজেদের যুগলবন্দীদের কাজ কিনা তা ও ভেবে দেখারবিষয়। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে থাকা কিছু নারীদের সম্ভ্রমহানি হয়েছে। মঙ্গলশোভাযাত্রার, কত নারীর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নাই বললাম।বিচার হয়েছে কি হয়নি জাতি না জানলেও এই লজ্জাজনক ঘটনা গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এর পর এই মঙ্গলশোভাকে বাধ্যতামূলক করার কথাউঠেছে।কেন? পান্তা ইলিশ তো কেউ খেতে মানা করেনি!মন্ডা মিটাই খেতে তো কেউ মানা করেনি। দলবেঁধে বেড়াতে যেতে তো কেউ মানা করেনি।মঙ্গল শোভাযাত্রা যদি এদেশের মানুষের সংস্কৃতির অনুসঙ্গই হয়, তবে বাধ্য করতে হবে কেন। আর সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার জিনিসও নয়।তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কেউ যদি মঙ্গল শোভারপক্ষ নিতে চায় নিক। কেউ যদি এর পক্ষে বলতে চায় বলুক। তবে আমি চাই যা কিছু হোক মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে যেন আমার বোনের শ্লীলতা হানি না হয়। শ্লীলতা হানির যেন শ্লীলতা। সংস্কৃতি এবং তার অনুষঙ্গ গ্রহণ বর্জনের অধিকার থাকুক ১৭ কোটি বাঙালির হাতে।

চারুকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশাল আবিষ্কার সেটা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। আসুন আমরা সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে একটু কথা বলি।

এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নাকি হাজার বছরের ইতিহাস। বাংলাদেশের সেকুলারদের সাথে পশ্চিমবঙ্গও নৃত্য করে পহেলা বৈশাখে। তারা বলে এটা পহেলা বৈশাখ না অস্টমির একডালিয়া, মানে দুর্গা পুজার একডালিয়া আরকি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা দেখি বিশাল এক নৌকা চলছে তার পিছনে বিশাল এক রাক্ষস তারে খাইতে আসছে। এ রাক্ষস শোভাযাত্রায় বারে বারে ব্যবহার করা হয়। সে মোটিভটা কী ? এটাকে চারুকলার লোকেরা বলে মৌলবাদের অপশক্তি। কালো গায়ের রং, মুখে দাড়ি মাথায় টুপি দৃশ্যমান।তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই মোটিভ নির্বাচন এবং এ প্রদর্শৃনীর পিছনে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা আছে। এ চিন্তা চারুকলা কিন্তু লুকায় না। তারা বলে তারা কোন মোটিভ দিয়া কি বুঝাইতেছে। মানুষ যা বোঝার বুঝে নিবে। তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রা একটা্ পলিটিক্যাল প্রজেক্ট। পলিটিক্যাল প্রজেক্ট তো সা্র্বজনীন হইতে পারে না। পলিটিক্যাল প্রজেক্ট তো আপনি সবাইকে মানতে বাধ্য করতে পারেন না। এটা তো সোশ্যাল ইভেন্টওতো হইতে পারেনা। সোশ্যাল ইভেন্ট তো সমাজ বানানোর নিয়ম মানতে হবে। সমাজ বানানোর সময় আমরা তো আমাদের মতের বিরুদ্ধে না যে তারে দিয়েও্র আমরা সমাজ গড়ি তাই না?সমাজতো বিভাজন তৈরি করে না । সমাজ ঐক্য তৈরি করে।আপনি তো সেই্ ঐক্য গড়ার কাজ করতেছেন না । তাই না?একজন মৌলবাদী হইলে অসুবিধা কি তারে আপনি সমাজে রাখবেন না?একজন যদি ধর্মের মৌলচিন্তা নিয়া চিন্তা ভাব্না করে তারে আপনি সমাজে রাখবেন না?আসলে আপনি শোভাযাত্রা দিয়া আপনার হাই মডার্নৃ পজিশন প্রজেক্ট করতেছেন। যে আপনার নৈতিকতা খুবই উঁচা আর অন্যেরা খুবই নিচে। আপনার পলিটিক্যাল অপ্পোনেন্ট হইতেছে দানব আর রাক্ষস। সে রাক্ষসকে নির্মৃল না করলে আপনার রুপকথা সার্থক হয় না।তাহলে এতোদিন ধরে আপনারা করছেন কি? আজকের এই নির্মূলের রাজনীতির গ্রাউন্ড তৈরি করে ফেসিস্ট শাসনের বৈধতা তৈরির কাজ।এটা কেমনে মহান কাজ হইল? এটা্ কেমনে আমার ঐতিহ্য হইল?মঙ্গল শোভাযাত্রার মোটিভ নিয়া আরো অনেক আপত্তি আছে। আপনারা তো ধর্মৃ নিরপেক্ষ । ধর্ম গন্ধের মোটিভ ব্যবহার করেনা।কোন ছুতায় একটা দাড়ি টুপি পরা ফিগাররে অশুভ বলে হাজির করা। আমি বলছি এইটা কইরেন না । মানুষ এইটা ভালো চোখে দেখে না।দাড়ি টুপি পরা একজন লোককে দেখলে আমাদের জনগণ উঠে সম্মান দেয়।আর আপনি সেই ফিগারকে অশুভ দেখান কোন আক্কেলে? মানুষে তো মুখে কিছু কইতেছে না । কিন্তু মনে মনে কষ্ট পাইতেছে। এটি আমার অনুভব । গণমানুষের সাথে সম্পর্কহীন এই কালচারাল এলিটরা আমাদের কথা শোনে নাই। তবে মনে হয়।এর মধ্যেই এই শোভাযাত্রা থেকে মানুষ মুখ ফিরাইয়া নিয়েছে।তাই এখন ভ্যালেনটাইন ডে এর বদলে বসন্ত উৎবের দিকে মানুষ ঝুঁকছে বেশী। কারণ ভ্যালেনটাইন ডে’র কুৎসিত রূপ এর ইতিহাস অনেকে জেনে গেছে।যাক ঐ শোভাযাত্রায় থাকে পঞ্চাশজন লোক আর দুই’শ পুলিশ। এবার আসুন আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম নিয়া কথা বলি।মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম থাকে এক বছর একেকটা। আপনি যদি শোভাযাত্রার থিম ধরে সার্চৃ দেন তাহলে সেই সময় বাংলাদেশের পলিটিক্যাল স্ট্রাগলের মুখটা কোন দিকে ছিল সেইটা ধরতে পারবেন।বাংলাদেশের প্রগতিবাদীরা যেমন বাকশাল, কম্যুনিস্ট, প্রগতিবাদী তাদের পলিটিক্যাল স্টান্ড কি নিয়েছিল সেইটা ধরতে পারবেন। ২০১২ সালে তাদের থিম ছিল রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অনিঃশেষ। তখন চলছিল জামাত নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি। তখন থিম নিল “ উদ্ধত কর জাগ্রত কর নিভৃত করহে”।সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ২০২১ সালের থিম ।। তখন থিম নিল কি “ কালো ভয়ংকরের দেশে ঐ আসে সুন্দর।

”এইবার আসেন পহেলা বৈশাথের গান নিয়া । পহেলা বৈশাখে যে গান গায় সেটি কি আমরা গ্রহণ করতে পারি? পহেলা বৈশাখে বেণি দুলিয়ে গান গায় আর কি।তার মাঝে ফূল টুল ও গুইজ্জা দেয় আর কি। তারা গায় “তাপস নি:শ্বাস বায়ে মুমুর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জৃনা দুর হয়ে যাক। অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা।”যা কিছু পুরাতন সে কি জীর্নৃ?আমরাতো পুরানা। শেখ ‍মুজিবও তো পুরানো। মুক্তিযুদ্ধওতো পুরানা। তাই না।বাংলাদেশও তো পুরানা পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে। আহসান মঞ্জিলও তো পুরানা,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তো পুরানা। যা কিছু পুরানো সেগুলিতো আমাদের স্মৃতি,সেগুলি তো আমাদের ইতিহাস,সেটি আমরা আজকে যে হয়ে উঠছি,সে হয়ে উঠার ইতিহাস।পুরানোরে আমরা কি ভাসাই দিতে পারি। মুমুর্ষৃরে কি আমরা উড়াই দিতে পারি?পারিনাতো । তাদের রক্ষা করা আমাদের কর্তৃব্য। মুমুর্ষুরে আমাদের রক্ষা করতে হবে। অগ্নিস্নানে পৃথিবীকে সূচি করতে হবে।তার মানে পৃথিবী কি অসুচী। অপবিত্র? পৃথিবীতো অসুচি বা অপবিত্র না , যে তারে আগুনে পুড়াইয়া সূচি করতে হবে।আগুনে দিয়ে পুড়া্ইয়া সূচি করে তো অগ্নি উপাসকেরা। আমরা কি অগ্নি উপাসক?অপর ,অন্য সে আপনার দুনিয়াকে অপবিত্র অসুচি করে রাখছে, আপনি তারে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া পবিত্র করবেন।এটি হচ্ছে ওয়ার এন্ড টেরর পলিসি।আপনারা এই গানটারে মোটিভ বানান আপনারা এই গানটারে থিম বানান। মূল মোটিভের ভয় দেখানো চক্ষু জ্বল জ্বলে সুর্যৃ থাকে। হাতে তো কার্পেট বোমা নিয়া যুদ্ধ করা যায় না তাই না। এইভাবে ওয়ার এন্ড টেরর গেলাইতেছেন। ওয়া্র এন্ড টেরর জিন্দাবাদতো কইতে পারেন না, তাই বলেন অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা।বাহ্ কি চমৎকার বুদ্ধি। পহেলা বৈশাখ হইতেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের একটি কালচারাল প্রজেক্ট। বাঙালি সেক্যুলার বামপন্থি প্রগতিশীলরা যে যে প্রজেক্ট প্রমোট করবে,সেটাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করাটা দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের কাজ।সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোক রবীন্দ্রনাথ হোক,মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক যা কিছু হোক, সেটাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।প্রত্যাখ্যান একটা রাজনৈতিক অস্ত্র, এটাকে আমরা নির্মম ভাবে প্রয়োগ করবো।