অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

খুব বেশী প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজে ব্যবস্তার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশআমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালীর পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করাহয়। অধিকাংশ ব্যক্তির নামের শেষে পদবী নামক একটি পুচ্ছযুক্ত হয়ে আছে। যেমন উপাধি উপনাম কিংবা বংশসুচক নামকে সাধারনভাবে পদবী বলা হয়।বাঙালীর জমি জমা সংক্রান্ত কিছু পদবী যেমন হালদার, মজুমদার ,তালুকদার ,পোদ্দার ,সরদার,প্রামানিক হাজেরা,হাজারী,মন্ডল,মোড়ল ,মলিলক,সরকার ,বিশ্বাস ইত্যাদী বংশ পদবী রয়েছে হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের । বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো,খন্দকার ,আকন্দ, নিয়াজি ইত্যাদী আর বাঙালী হিন্দু শিক্ষকদেরপদবী হলো দিবেদী , ত্রিবেদী, চতুর্বেদি ইত্যাদী। এবার আপনাদের জানাবো বাঙালীর কিছুবিখ্যাত বংশ পদবীর ইতিহাস। যেমন শিকদার, সৈয়দ, শেখ, মীর, মোললা, দাস, হন্দকার, মিঞা, আকন্দ, চৌধুরী , ভুইয়া , মজুমদার, তরফদার, তালূকদার, মলিলক, মন্ডল,সরকার, ফরিক,আনসারী,দত্ত।শিকদার:সুলতানী আমলে এক একটি মহল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিখ। আরবী শিখ হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসী ‘দার’ যুক্ত হয়ে শিকদার বা শিকদার শব্দের উদ্ভব হয়। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী। শব্দ কোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তি রক্ষক কর্মচারী। এরা শিখবন্দুক বা ছড়িবন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিখ উপাধি পেয়েছিল। সেই থেকে বংশপরম্পরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।

সৈয়দ:  সৈয়দ পদবী মুলত এসেছে নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ওহযরত আলীর বংশথেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোন যোগ সুত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবাহার করে নিজেকে সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবী করেন।বাঙালী মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও প্রক্ষেপন ঘটেছে অনেক বেশী।

শেখ:  শেখ আরবী থেকে আগত শব্দ। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মান সুচক বংশপদবী শেখ। যিনি সম্মানীত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান তাঁকে বলা হতো শেখ। হযরতমোহাম্মদ সা: সরাসরি যাকে বা যাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলে,তিনি বা তার বংশধরশেখ নামে অভিসিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালী মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারন করেন তারা এমন ধারনা পোষন করেন যে, তারা বা তাদের পুর্বপুরুষরা এসেছিলেন সৌদি আরব থেকে।

মীর :  শব্দটি এসেছে আরবী থেকে। আরবী শব্দ আমীরের সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছেআমীর।সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি সরদার বা ইত্যাদী। জিতে নেওয়া বাজয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দ ব্যাবহার হতো।তবে মীর বংশের লোককে সম্ভ্রান্ত এবং সৈয়দ বংশীয় পদবী ধারীদের একটি শাখাকে গবেষকরা মনে করেন।

মিঞা:  মিঞা মুসলিম উচ্চপদস্থ সামাজিক ব্যাক্তিকে সম্বোদন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রমসুচক শব্দ। এর অর্থে সকল মুসলমানের সম্বোদন হচ্ছে মিঞা। বাঙালী হিন্দুর মহাশয় এর পরিবর্তে বাঙালী মুসলমানরা মিঞা শব্দ ব্যবহার করেথাকে।মিঞা শব্দটি এসেছে ফার্সী ভাষা থেকে। মোললা: মোললা এবং মুনসী বাঙালীল দুটিজনপ্রিয় পদবী।তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী।বঙ্গীয় শব্দ কোষে মোললা শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে

মুসলমান পুরোহীত। বস্তুত এভাবে মসজীদে নামাজ পরিচালনার কারনেও মোললা উপাধী পেয়েছিল।প্রকৃতপক্ষে মোললা হচ্ছে তুর্কি ও আরবী ভাষার মোললা থেকে আগত একটি শব্দ।যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপুর্ন জ্ঞান বিশিষ্ট মহা পন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পন্ডিত ,ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোললা। দাস: বাঙালী হিন্দুসমাজে দাস বা দাস বংশপদবীর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যে সমস্থ হিন্দু সমম্প্রদায়ের মানুষ পদবীতে দাস লেখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন। আর যারা দাসী লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভৃত্য চেতনা থেকে এসেছে।

খন্দকার : মুসলিম সমাজের ফার্সী শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায়।অন্যদিকে খন্দকারের পদবী এসেছে সামন্তসমাজ থেকে পেশাজীবি হিসেবে।সাধারনভাবে খোন্দকার বা খন্দকার হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী।

চৌধুরী: সংস্কৃত চতুর্ধারী শব্দ থেকে এসেছে চৌধুরী।এর অর্থ চতুরসীমানার অন্তর্গত অঞ্চলের শাসক।বাংলাদেশের বেশীর ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন চৌথধারী যার অর্থ একচতুর্থাংশ রাজস্ব আদায়কারী।সেখান থেকে উচ্চারন পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী।

ভুইয়া: এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভুমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালী মুসলীম ও হিন্দু উভয়ের মধ্যে এই পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালী হিন্দু সমাজে যারা ভৌমিক ,মুসলমান সমাজে তারা ভুইয়া পদবী ধারন করেছেন।আবার যেসম মানুষ স্থানবিশেষে বনজঙ্গল পরিস্কার করে বনতী ও চাষাবাদের পত্তন করেছে তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভুইয়া নামে অভিহিত হয়ে সব জমি জমার সত্ব লাভ করেছে।

মজুমদার: মজুমদার পদবীর মুল ফারসী শব্দ হচ্ছে মজবু আন্দর। রাস্ট্রের ও জমিদারদের দলীল পত্রাদীর রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্য এই পদবী সংরক্ষিত ছিল।হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাঙলাদেশে মজুমদার পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।

তরফদার: আরবী শব্দ তরফ এবং ফার্সী দার মিলে তরফদার শব্দের সৃস্টি।রাজ্যের খাজনা আদায়ের মহলে তরফদারী বা খাজনা আদায়কারীর উপাধী ছিল তরফদার।এই পদবী ব্যবহারকারীর গোষ্ঠীর পুর্ব পুরুষরা রাজকার্যপরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

তালুকদার : আমাদের দেশে পরিচিত একটা বংশপদবী।বাংলাদেশে জমিদারের পর তালুক ভুসম্পত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়ভিত্তিক পদবীর যে উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে তালূকদার হচ্ছে অন্যতমপদবী।

সরকার : সরকার শব্দটি ফার্সী থেকে আগত । এর অর্থ প্রভু, মালিক , ভুস্বামী ,শাসনকর্তা, রাজা।অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারী ও সরকার।মোগল আমলে স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এই পদবী দেওয়া হতো।মললিক : আরবী মালীক বা মালিক শব্দ থেকে এসেছে মললিকবংশ পদবী। ফার্সী মালিক শব্দ যার মললিক যোদ্ধাদের উপাধী গ্রাম প্রধান বা সমাজের প্রধানব্যক্তি মালিক।

মন্ডল: বাঙালী হিন্দু মুসরিম সমাজে সমানভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী।বাংলাদেশেঅধিক কালথেকে গ্রামের অনানুষ্টানীক এবং সাধারনভাবে গ্রাম প্রধানকে বলা হয় মন্ডল।বাংলা মন্ডলেরা আগে অত্যান্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মন্ডলীয় কাজে তারা অনেক অধিকার ভোগকরতেন।খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীন বিপদ আপদ মিমাংসা করতে মন্ডলেরা কার্যকরী ভুমিকা পালন করতেন।

ফকির: মুসলমানদের মধ্যথেকে সনন্যাস বৃত্তি থেকেইএসেছে ফকির পদবী।মরমী সাধকরা গ্রহন করতেন ফকীর পদবী।এটি আরবী শব্দ যার অর্থ নি:স্ব।আবার আরবী ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির এবং পার্শী দরবেশব্যক্তিগন সাধারনত এদেশে ফকির নামে পরিচিত।বিশেষ কোন ধর্মের মতের একান্ত অনুসারী নাহয়ে যারা সকল ধর্মের মুলনীতি নিয়ে আত্মতত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়।আবারসুফী বা বাউল তত্তে¡র ধারকরাও ফকির।

ঠাকুর : বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরন বন্দোপাধ্যায় মতে ঠাকুর শব্দের মুল হচ্ছে ঠাক্কুর। তার থেকে প্রকৃত ঠকুর এবং বাংলা ঠাকুর এসেছে।পদবীগত দিক থেকে তা ব্রাম্মনের পদবী বিশেষ।এমনকি ক্ষত্রিয়রাও উপাধী এটি।মধ্যযুগের কাব্য চৈতন্যভগবত উদৃত করে লেখক বলেছেন তা বৈষ্ণব্ ও উপাধী। যেমন হরিদাস ঠাকুর ,পাচক ব্রাম্মন ও একপ্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। এরকম শতাধিক বংশ পদবী রয়েছে আমাদের দেশে। বাঙালীর পদবীর ইতিহাস বৈচিত্রপদ ও মতের এক অসাধারন স্মারক হিসেবে চিহ্নিত।