– মমতাজ উদ্দিন আহমদ

মৃত্যু। ছোট একটি শব্দের মাঝে নিহিত আছে শোক, বিচ্ছেদ আর যাতনা।

মৃত্যুকে প্রাণীকুলের জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অবধারিত হিসাবে বলা হয়েছে। আল কুরআনের ঘোষণা- কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত। অর্থাৎ- প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

গত ক’দিন ধরে ‘মৃত্যু’ শব্দটি বারবার মনে দোলা দিচ্ছে। একান্ত মানবিক সম্পর্কের কারণে কিছু মানুষের মৃত্যু হৃদয়নদের একুল ওকুল দু’কুল চাপিয়ে শোকের বানে তলিয়ে যায়।

২০২২ এর ডিসেম্বর মাসে পরপর তিনটি মৃত্যুর বিয়োগ ব্যথা সইতে হয়েছে। এরমধ্যে একটি মৃত্যুর বিয়োগ ব্যথায় অঝোরে অশ্রুপাত হয়েছে।

‘জীবনস্মৃতি’ নামের আত্মজীবনীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নিবন্ধের নাম “মৃত্যুশোক”। নিবন্ধে কবি মৃত্যুশোক নিয়ে তার ভাবাবেগের কথা নিদারুণ মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

কবি লিখেছেন “… নিকটের মানুষ যখন এক সহজে এক নিমিষে স্বপ্নের মতো মিলাইয়া গেল তখন সমস্ত জগতের দিকে চাহিয়া মনে হইতে লাগিল, একি আত্মখ-ন! যাহা আছে এবং যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে কোনোমতে মিল করিব কেমন করিয়া।”

বিশ্বকবির এ অনুভূতির অদ্ভুত মিল ঘটে গেল সেদিন আমার জীবনে। ২০ ডিসেম্বর সকাল ১০ টা ৩২ মিনিটের সময় সাতুল বড়ুয়ার সাথে মুঠোফোনে আমার কথা হয়। ক্ষীণকণ্ঠে জানালেন- ‘আগের দিন থেকে তাঁর প্রেশার বেড়েছে। চকরিয়া যাবেন চিকিৎসা নিতে।’ কথা শেষ হলো। ১৫ মিনিট পর শোনা গেল সাতুলা দা’ মারা গেছেন!

খানিক আগে একজন প্রিয় মানুষ ছিল, পরক্ষণে আর নেই; এই উভয়ের মধ্যে আমি মিল খুঁজতে গিয়ে ভাবাবেগে আত্মহারা হয়ে গেলাম।

সাংবাদিকতায় আমার দু’দশকের বেশী সময় ধরে ঘনিষ্ট সাংবাদিক সতীর্থ বান্দরবানের বদরুল ইসলাম মাসুদ ও চকরিয়ার জাকের উল্লাহ চকোরী জীবন পরিক্রমা থেকে চির বিদায় নিলেন নিরবে-নিভৃতে। মৃত্যুর আগের দিনের কথা ছিল সাংবাদিক মাসুদ পরের দিন আলীকদমে পেশাগত কাজে আসবেন। কিন্তু নিয়তি তাঁকে সে অবসর দিলো না! ওইদিন রাতেই পরপারে পাড়ি দিলেন সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে।

এ ডিসেম্বরে আরেকজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাদেরকে ছেড়ে মহান প্রভূর সান্নিধ্যে পাড়ি দিলেন। সাংবাদিক জাকের উল্লাহ চকোরী বোধহয় মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকেই মহান প্রভূর সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর ক’দিন আগেও তিনি আমাদেরকে জানালেন, ‘রিজিক নির্ধারিত, মৃত্যু অবধারিত…’। এ কথা বলার দু’দিন পর তিনি মারা গেলেন।

বর্ণিত জীবন-মৃত্যুর এই রন্ধ্রের ফাঁক দিয়ে আমি যা দেখলাম আর প্রকাশিত হলো তা গত কয়দিনে আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগলো। আমার কাছে মনে হলো মানুষের জীবন কখনো অবিচলিত নিশ্চিত সত্য নয়। যা আশেপাশের প্রিয় মানুষগুলোর মৃত্যুর খবরে মনের দুঃখের ভার লঘু করে দেয়।

জীবন হতে জীবনান্তের যে বিচ্ছেদ তা আমার জীবনে প্রথম উপলব্ধি হয়েছিল ছাত্রাবস্থায়। ১৯৯৫ সালের ৫মে বিকেলে খবর পেলাম আমার একজন শিক্ষাগুরু মারা গেছেন। তরুণ বয়স। তার মৃত্যুর শোকের প্রাবল্য কতটা গভীর হতে পারে তা বুঝলাম না। তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও খাটিয়ায় তার সজাগ দেহখানি সুখসুপ্তির মতো প্রশান্ত ও মনোহর রূপে দেখে এসেছিলাম। ক’দিন যেতে না যেতেই সেদিন বিকেলে আমার সেই শিক্ষাগুরুর যখন মৃত্যুসংবাদ শুনলাম, তখন সে কথাটির অর্থ সম্পূণরূূপে গ্রহণ করতে পারিনি।

মৃত্যুর পরদিন সকালে যখন মৃতদেহ জানাযা আর কবরস্থ করবার জন্য খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন পশ্চাতে পশ্চাতে চলতে লাগলাম। এ সময় স্বজন-পরিজন আর মরহুমের গুণগ্রাহীদের যে আত্মবিলাপ এবং বিচ্ছেদ বেদনার করুণ আহাজারি দেখলাম হৃদয়কে সেদিন নিদারুনভাবে নাড়া দিল। এক দমকায় সেদিন আমার মনের ভিতরটায় একটা হাহাকার আওয়াজ উঠেছিল।

প্রিয়জনের মৃত্যু যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া এ জগতে কস্মিনকালেও কেউ কল্পনা করতে পারবেনা। যার জীবনের নিরবচ্ছিন্ন পরিক্রমায় প্রিয়জন বিচ্ছেদের কোনো ঘটনা ঘটেনি তার পক্ষে সহজে বুঝা সম্ভব নয় জীবনের মধ্যে যে কিছুমাত্র ফাঁক আছে। তার কাছে জীবনের উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে।

আপনার চারপাশে আলো, বাতাস আর গাছপালা যেমন চিরন্তন সত্য হিসাবে বিরাজ করছে তেমনি স্বজন-পরিজন-প্রিয়জনের উপস্থিতিও নিরেট সত্য। এই চিরায়ত সত্যের মাঝে হঠাৎ আত্মখ-ন হয়ে জীবন থেকে জীবনের ফাঁক তৈরী করতে হঠাৎ উপস্থিত হন মৃত্যুর দূত মালাকুল মউত আজরাইল! তখন মরণের বৃহৎ পটভূমিকায় জীবনসায়হ্নের ভয়ংকর রূপটি কী হতে পারে তা ভেবে শরীর-মন শিউরে উঠে।

লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।