অনলাইন ডেস্ক:

সেন্টমার্টিন থেকে ১৩শ শতাধিক পর্যটক নিয়ে ১৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার পৌঁছেছে বে-ওয়ান ক্রুজ নামক পর্যটকবাহী প্রমোদতরী জাহাজ। ইঞ্জিনে ত্রুটি সৃষ্টি হয়ে অতি ধীরগতিতে চলাচল করায় ৫ ঘণ্টার ভ্রমণযাত্রা এত দীর্ঘসময় লাগায় ক্ষুধা, ভয় ও আতঙ্কে এসময় দিশেহারা হয়ে পড়েন পর্যটকরা।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে আসা জাহাজটি রাত ৯টার দিকে গভীর সমুদ্রে আটকে যায়। জাহাজটিতে ১ হাজার ৩শর’ বেশি পর্যটক ছিল বলে জানা গেছে।

বুধবার (২১ ডিসেম্বর) ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজার শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে পৌঁছে বে-ওয়ান থেকে পর্যটকদের স্থানান্তরিত হওয়া বার আউলিয়া জাহাজটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেওয়ান ক্রুজ নামে এই প্রমোদতরী জাহাজটি চট্টগ্রাম সরাসরি সেন্টমাটিন রুটে বিভিন্ন প্যাকেজে পর্যটক আনা নেওয়া করে। মঙ্গলবারও ১৩ শতাধিক পর্যটক নিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টায় কক্সবাজার-চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয় জাহাজটি। কক্সবাজার পৌঁছানোর কথা রাত সাড়ে ৯টার দিকে। কিন্তু জাহাজের ত্রুটিতে অতি ধীরগতি, সর্বোপরি কক্সবাজার পৌঁছাতেই বেজে যায় ভোর ৫টা।

ফেরত আসা ক্ষুব্ধ পর্যটকরা জানান, এত দীর্ঘ সময় বে-ওয়ান জাহাজ সাগরে থাকায় ক্ষুধার কষ্টে অস্থির হয়ে ওঠেন পর্যটকরা। বিশেষ করে নারী পর্যটকরা জানান, শিশু এবং বয়স্ক মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে। অনেকে ভয় ও আতঙ্কে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশুসহ অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকে বসার জায়গা না পাওয়ায় ১৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে এই দুবির্ষহ সমুদ্রযাত্রা উপভোগ করেছেন। সময় মতো পৌঁছাতে না পারায় অগ্রিম বুকিং করা বাসও মিস করেছেন অনেক পর্যটক।

রাজধানী থেকে আসা এক দম্পতি জানান, সমুদ্র উত্তাল ছিল, এ সময় বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করার কথা কানে তোলেননি। তিনটি সিঙ্গারা বিক্রি করেছে ১০০ টাকায়, খিচুড়ি ২৫০ টাকা। এটা মানুষকে ভ্রমণের নামে জাহাজে তুলে একরকম পকেটের টাকা ছিনিয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরেকজন জানান, সাড়ে ৭ হাজার টাকায় কেবিনের টিকেট কিনেও তাকে খাবারও দেয়া হয়নি। তার স্ত্রী জানান, বাচ্চাদের নিয়ে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কে রাতভর সমুদ্রে ভয়াবহ সময় কেটেছে। এমন সময় যেন জীবনে কারো না আসে।

কলকাতা থেকে আসা আরেক চিকিৎসক দম্পতি জানান, নাম শুনে জাহাজের টিকিট কেটেছিলাম। ভ্রমণনামক যন্ত্রণাময় এ যাত্রায় কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অসহযোগিতা ছিল চরম পর্যায়ে। রাতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ যাত্রীকে খাবার দেয়া হয়েছে। অথচ তাদের উচিত ছিল সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা। তারা আরো বলেন, আগের দিন ভোর ৫টায় ঘাটে আসি সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য আর পরদিন ভোর ৫টায় ফিরেছে কক্সবাজার। ২৪ ঘণ্টার যাত্রায় মাত্র ৪৫ মিনিট দ্বীপে অবস্থান করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

জসিম উদ্দিন শুভ নামে এক ট্যুর অপারেটর প্রশাসনের হেল্প চেয়ে তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাদের বাঁচান। একদিকে জাহাজে পথে পথে হয়রানি অন্যদিকে বাস মিস করাই মধ্যবিত্ত পরিবারদের কান্না দেখে নিজের চোখে পানি চলে আসছে। তারমধ্যে অফিস থেকে বস দিচ্ছে বকা, যেমনি হোক চাকরি বাঁচাতে আগামীকালকে সকাল দশটার মধ্যে অফিসে হাজির হতে হবে। কিন্তু আমরা এখনও সাগরে ভাসছি। দেখার কেউ নেই। নেই কোনো খাবার। দোকানপাট বন্ধ। কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ও বার আউলিয়া নাম দিয়ে বুকিং নিয়ে দুই শিপের যাত্রী এক শিপ করে অর্থাৎ বে-ওয়ান শিপে করে কয়েকদিন ধরে যাওয়া আসা শুরু করছে। কোম্পানি তারই ধারাবাহিকতায় কবলে পড়ে ভ্রমণে আসা আজ প্রায় ২ হাজার পর্যটকের বাস মিস হয়েছে। এর দায়ভার কে নেবে, কেউ কি বলতে পারবেন?’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে কর্ণফুলী ক্রুজ লাইনের কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম জানান, জোয়ার-ভাটাজনিত কারণে কক্সবাজার থেকে বারো আউলিয়া জাহাজে করে গভীর সমুদ্র থেকে কক্সবাজার ঘাটে যাত্রীদের ফেরত আনতে সময় লেগেছে। এতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না বলে দাবি করেন তিনি। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তবে দুর্ঘটনা নয়। সব যাত্রী নিরাপদে ফিরেছে।

যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করার বিষয়ে তিনি জানান, পরিস্থিতি সেরকম হয়নি বলেই লাইফ জ্যাকেট দেয়া হয়নি। জাহাজে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ছিল।

সব যাত্রীর খাবার না পাওয়া নিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, সবাইকে খাবার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অতিরিক্ত দামের জবাবে তিনি বলেন, জাহাজের খাবারের দোকান কর্তৃপক্ষ অন্যজনকে ভাড়া দিয়েছে, এখানে জাহাজ কর্তৃপক্ষের করার কিছু নেই।

এদিকে বুধবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ কর্ণফুলী জাহাজ এবং সকাল ৮টা নাগাদ বে ওয়ান সময় ক্রুজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে কক্সবাজার থেকে রওয়ানা করেছে বলে জানা গেছে।

এর আগে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে গভীর সমুদ্রে ইঞ্জিন বিকল ও আগুন লেগে সাড়ে ১৩ ঘণ্টা পর ফিরে আসে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড পরিচালিত প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’। ওই সময় জাহাজে পরিবারসহ ছিলেন সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। পরে বন্দরের টাগবোট ‘কাণ্ডারি-১০’ এর সহযোগিতায় পতেঙ্গা ওয়াটার বাস টার্মিনালে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। বড় ধরণের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় জাহাজের হাজারেরও বেশি যাত্রী।

এরও আগে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ায় ভারসাম্য রাখতে না পেরে কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগরের বাকখালীর মোহনায় চরে ছয় ঘণ্টা ধরে আটকা পড়ে একই কোম্পানির সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারগামী আরেকটি জাহাজ কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। পরে চট্টগ্রাম থেকে প্রমোদতরী বে ওয়ান গিয়ে যাত্রীদের সেন্টমার্টিন পৌঁছে দেয়।

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকদের প্রধান মাধ্যম জাহাজ। প্রতি বছর লক্ষাধিক পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যা। এই বছর টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় বিকল্প হিসেবে কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী নামক একটি জাহাজ চলাচল করে। এসময় পর্যটক বেশি হাওয়ায় কর্ণফুলীর পরিবর্তে বে-ওয়ান জাহাজ চলাচল করে। তবে দিন দিন এই জাহাজ ভ্রমণ রীতিমতো দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।