জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমে ২১ বছরেও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে এ ব্যর্থতার কথা স্বীকার করা হয়েছে।

গত জুনে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে নির্ভুল জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সাতটি সমস্যা ও সমাধানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো নতুন- সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূর করা, একাধিক নিবন্ধন বাতিল করা, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্য নিবন্ধন নিশ্চিত করার হার বৃদ্ধি, মৃত্যুর নিবন্ধনের হার বৃদ্ধি, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নতুন সফটওয়্যারের সংযোগ স্থাপন, জন্ম তারিখ সংশোধনের অস্বাভাবিক প্রবণতা কমানো এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব।

তবে বাস্তবে মানুষ জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। উল্টো নির্ভুল তথ্য দিয়ে সনদ দিতে না পারার জন্য নাগরিকদের দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনে অভিভাবকের অনীহা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধনের জন্য স্কুলে ভর্তির আগ পর্যন্ত অপেক্ষা। পরবর্তী সময়ে স্কুলের সনদ দিয়ে জন্ম নিবন্ধন করা বা সংশোধনের আবেদন করা।

কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য লিপিবদ্ধ করার সময় কর্মীদের ভুলের কারণে সেবাগ্রহীতার দুর্ভোগের বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। নিবন্ধনের সময় একটি তথ্য ভুল হলে সেবাগ্রহীতাকে অন্তত দুটি দপ্তরে সংশোধনের জন্য ঘুরতে হয়, সিটি করপোরেশন বা ইউনিয়নে এবং জেলা প্রশাসক বা ইউএনওর কার্যালয়ে।

এ অবস্থায় ‘নির্ভুল জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করব, শুদ্ধ তথ্যভাণ্ডার গড়ব’ এই প্রতিপাদ্যে বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস উদযাপন করছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়।

স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, জন্ম নিবন্ধন সংশোধনে অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ব্যাপারে কাউকে হয়রানি না করতে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

২০০১ সালে হাতে লিখে প্রথম নিবন্ধন শুরু হয়। ২০১০ সালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ডিজিটাল নিবন্ধন শুরু হয়। সেই সফটওয়্যার অকেজো দাবি করে ২০১৯ সালে সরকার নিজেই নতুন সফটওয়্যারে জন্ম নিবন্ধনের তথ্য সংরক্ষণ শুরু করে। তিন বছরের মাথায় এসে এখন বলা হচ্ছে, এই সফটওয়্যারটিও হালনাগাদ (আপডেট) করতে হবে।

জন্ম নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বলেন, নতুন সফটওয়্যারে কিছু চাহিদার কমতি আছে। ম্যানুয়ালি যেসব তথ্য যুক্ত করা হয়েছে সেখানে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। প্রয়োজন হলে সফটওয়্যার আবার আপডেট করা হবে।

নতুন এই সফটওয়্যার তৈরির জন্য ১৫ কোটি টাকা দিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট জামিলা আক্তার বলেন, নতুন সফটওয়্যারের অর্ধেক কাজ এখনো হয়নি। চাহিদার বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করেনি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নিবন্ধনের কাজ নির্ভুল করা যাচ্ছে না। আগে একই ব্যক্তির দুইবার নিবন্ধন বা দ্বৈততা ছিলো। আবার অনেকে অজ্ঞতার কারণে নিবন্ধনে ভুল করছে। কোনো কোনো নিবন্ধন কার্যালয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এমন নানা জটিলতার কারণে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ডাটাবেইস বা তথ্যভাণ্ডার নির্ভুল করা যাচ্ছে না।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের এই তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে ইউনিসেফ ২১ বছরে ১৭০ কোটি টাকা খরচ করেছে। বাংলাদেশ সরকার গত দুই বছরে খরচ করেছে ৬০ কোটি টাকা। এর আগের ১৯ বছর সরকার কত টাকা খরচ করেছে সে তথ্য তাত্ক্ষণিকভাবে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্রের দাবি, ২০১০ সালে ইউনিসেফের তৈরি পুরনো সফটওয়্যারে নিবন্ধন করা তথ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ দ্বৈততা আছে। এটা দূর করার জন্যই নতুন সফটওয়্যার নেয়া হয়। কিন্তু নতুন সফটওয়্যারে বেশির ভাগ সময় কাজ করা যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ফিচার ঠিকভাবে কাজ করছে না।

সব মানুষকে জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আনতে ২০০১ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় প্রকল্প শুরু হয়। তখন হাতে লেখা জন্ম ও মৃত্যু সনদ দেয়া হতো। এরপর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে বার্থ রেজিস্ট্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেম (বিআরআইএস) নামে সফটওয়্যার চালু করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পাসকনের কাছ থেকে সফটওয়্যার তৈরি করে নেয় ইউনিসেফ। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করা এবং দ্বৈততা চিহ্নিত করার সুযোগ ছিলো না। ফলে অনেকে একাধিক জন্ম সনদ নিয়েছে। স্কুলে ভর্তি, বাল্যবিবাহ, চাকরি, পাসপোর্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো বয়স নির্ধারণ করেছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গারাও নিয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। নানা অনিয়ম করছে জালিয়াতচক্র।

এই পরিস্থিতিতে নির্ভুল এবং দ্রুতগতির জন্মনিবন্ধন সার্ভার তৈরির জন্য ২০১৯ সালে বার্থ-ডেথ রেজিস্ট্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেম (বিডিআরআইএস) নামে নতুন সফটওয়্যার চালু করা হয়। ‘রিভ সিস্টেম’ নামে একটি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করেছে। তবে একবার মেয়াদ বাড়ানোর পরও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এটি বুঝিয়ে দেয়নি।

২০ কোটি ১২ লাখ জন্ম নিবন্ধন

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সারাদেশে গত জুন পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন করেছে ২০ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৪ জন। দ্বৈত নিবন্ধনের কারণে সংখ্যাটি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বড় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ২১ বছরেও কেন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের নির্ভুল ডাটাবেইস করা যাচ্ছে না এজন্য সরকারকে তদন্ত কমিটি করে কারণ বের করতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে গুণগত উপাত্ত প্রয়োজন, যে ডাটার ভিত্তিতে সঠিক পরিকল্পনা নেয়া যাবে।

তিনি বলেন, দুর্বল সফটওয়্যারের কারণে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। গত বছর সফটওয়্যারের তথ্য আপডেট করতে গিয়ে অনেকের তথ্য হারিয়ে গেছে। তাই সফটওয়্যার বদল হলেও যাতে তথ্য হারিয়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত, দেশ ও দেশের বাইরে পাঁচ হাজার ৫৩২টি জায়গা থেকে জন্ম নিবন্ধন করা যায়। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পাশাপাশি বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
– আজকের পত্রিকা