মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডের ২ বছর পূর্তি আজ ৩১ জুলাই। ২০২০ সালের এদিনে ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। পুলিশের গুলিতে মেজর (অব:) সিনহা হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

তখন নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের গাড়ি থেকে কিছু ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের কথা বলে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ হতে দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। কিন্তু ঘটনার পরদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’ এই হত্যাকান্ডের বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়, গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জনগণও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তাতে আলোচিত সিনহা হত্যা মামলা গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত তদন্ত ও অভিযোগপত্র দায়েরের মাধ্যমে তা বিচারিক পর্যায়ে চলে যায়।

হত্যাকান্ডের পাঁচদিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর : এসটি-৪৯৩/২০২১ ইংরেজী। যার জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি। যার টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০ ইংরেজি।

এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জেলা পুলিশ প্রশাসনের পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, এসআই, এএসআই, কনস্টেবল সহ কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রায় ১৪ শত সদস্যকে কক্সবাজার থেকে একযোগে বদলী করা হয়। গঠিত হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (যুগ্মসচিব) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এই কমিটি তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ সহ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত’কে। আদালত থেকে র‍্যাব-১৫ কে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়।

এরপর মামলার আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় ৩ জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরো মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামী কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে। আসামীদের মধ্যে ১২ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। শুধু ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাগর দেব আদালতে জবানবন্দি দেননি।

এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষী সহ আলোচিত মামলাটির চার্জসীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন র‍্যাব-১৫ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকান্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) বিভিন্ন ধরনের আলামত ও ডিজিটাল কন্টেন্ট আমলে এনে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের মামলায় চার্জসীট দেন। চার্জসীট থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৭ জুলাই সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সিফাত ও রুফতি নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউবে একটি ভিডিও চ্যানেল নিয়ে কাজ করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মি দশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহাকে জানায়। এসব জানতে পেরে সিনহা পীড়িত হন।

আরো জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ ওসি প্রদীপের কথিত রাজ্য ছিল। মূলত তার স্বেচ্ছাচারিতা, আইন অমান্য করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা এবং তার অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সিনহা ও তার সঙ্গীরা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওসি প্রদীপ সরকারি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করতেন এবং ইয়াবাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

এসব বিষয়ে ওসি প্রদীপের কাছে জানতে ক্যামেরা ও ডিভাইসসহ সিনহা, শিপ্রা ও সিফাত থানায় যান। র‌্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, থানায় তাদের অনতিবিলম্বে টেকনাফ বা কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলা হয়। তা না হলে ‘তোমাদের আমি ধ্বংস করে দেব’ বলে হুমকি দেন প্রদীপ। ওসি প্রদীপের হুমকি উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণেই ষড়যন্ত্র করে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে জানায় র‌্যাব।

ঘটনার দিন সকাল থেকেই সিনহার গতিবিধি নজরে রাখা হয়। একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন। শামলাপুর এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে খুব কাছ থেকে চারটি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী।

এর কিছুক্ষণ পরেই প্রদীপ কুমার দাশ যখন ঘটনাস্থলে যান, তখনো মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন। এ সময় ওসি প্রদীপ সিনহার ‘মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পায়ের জুতা দিয়ে আঘাত করে’ বিকৃত করার চেষ্টা করেন। এর পরই সিনহার মৃত্যু হয়। পরে লোক দেখানোভাবে তাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক এ বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ৩০০ পৃষ্ঠার এ মামলার রায় দেন।মামলায় ২ আসামীকে মৃত্যুদন্ড ও ৬ আসামীকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়। মৃত্যুদন্ড দেওয়া আসামীরা হলো-বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এছাড়া একই রায়ে ৬ আসামী যথাক্রমে কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন, আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৮ জন আসামীর প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও প্রদান করা হয়।

মামলার বাকী ৭ জন আসামীকে মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। তারা হলো-কনস্টেবল সাফানুর করিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, কামাল হোসেন আজাদ ও মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করেছে। হাইকোর্টে দায়েরকৃত আপীল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।