বদরুল ইসলাম বাদল 

দেশের চলমান সকল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ধাপে ধাপে শেষ করতে চায় কমিশন।স্থানীয় সরকার শাসন ব্যবস্থার সব চেয়ে তৃণমূল প্রতিষ্ঠান হল ইউনিয়ন পরিষদ।কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা অবহেলিত। শুধু যেন নির্বাচনটাই প্রধান বিষয় ।নির্বাচনের পর জনগণের কোন খবর রাখে না অনেক চেয়ারম্যান, মেম্বার।অনেক ইউনিয়নে নাগরিকত্ব সনদ সহ নানাবিধ নাগরিক সুবিধা পেতে বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে থাকে জনগণ। কিছু সালিশ বিচারের কার্যক্রম চোখে পড়ে ।আবার সেখানে ও নানাবিধ অভিযোগ। বিচার বানিজ্য এবং বিচারের জামানতের টাকা নিয়ে ও অনেক কাহিনীর রটনা আছে।

ইউনিয়ন নির্বাচন বাঙালী জাতির কাছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি উত্সবের মতো। নারী পুরুষ সারিবদ্ধ ভাবে উত্সবের আমেজে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানে আনন্দিত হয়। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের ও কাধেঁ করে কেন্দ্রে আনা হয় ।জীবিকার তাগিদে এলাকার বাইরে থাকা ভোটার গন ভোটের দিন ভোট প্রদানের জন্য চলে আসতো। শুধু তাই নয় ভোটের কদর এমন ছিল যে, গ্রামের বাইরে বিবাহ দেওয়া মেয়েরা ও বাপের বাড়িতে চলে আসতো, ভোটের আমেজ দেখার জন্য। রাত দিন টিনের চোঙ্গা নিয়ে বড় আওয়াজে মিশিল।”অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র”। “তমুক ভাইয়ের সালাম নিন এই মার্কায় ভোট দিন”। আর খাওয়ানো হতো চা, সেমাই, বিস্কুট, পান, সিগারেট। তাতেই ছিল মানুষ সন্তুষ্ট। এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করতো না।কিন্তু দিন পাল্টে গেছে এখন। চা সেমাইয়ে এখন চলে না। বিরিয়ানি লাগে, মুরগীর রোষ্ট, গরু ভোনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয় নগদ টাকা ও দিতে হয় অনেক ক্ষেত্রে।সন্ত্রাসী ভাড়া করে অনেকে ভোট কেন্দ্র দখল করার জন্য,নির্বাচনে দায়িত্ব প্রাপ্তদের ও ম্যানেজ করার কথা উঠে অনেক জায়গায়।পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইলেকশনের চরিত্র পাল্টে যায়, ।ভোটের নামে প্রহসন, সেনা উর্দি নিয়ে হ্যাঁ না ভোট, কেন্দ্র দখল, বাক্স ডাকাতি, ফলাফল উল্টানো সহ কত কিছু।যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পুনঃ গঠনের প্রক্কালে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা জবর দখল করে সামরিক সরকার দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলে। স্বাধীন দেশে গনতান্ত্রিক সরকার কায়েমের লক্ষ্যে নব্বই দশকের শেষ অবধি অব্যাহত আন্দোলন করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ধ্বংস হওয়া সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠে না।তদুপরি পরাজিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং সাম্রাজ্যবাদী মদদপুষ্ট স্বৈরাচারি শাসকগোষ্ঠী মহান মুক্তিযুদ্ধে গড়ে উঠা জাতীয় ঐক্যে বিভাজন সৃষ্টি করে।ফলে জাতির মাঝে বিভক্তি, দোষারোপ আর ভুল বুঝাবুঝি চরম আকার ধারণ করে। যার থেকে উত্তরণের পথ কঠিন হয়ে পড়ে।যার ফল ভোগ করছে বর্তমান প্রজন্ম অদ্যাবধি।

অনেক ভোটার ভোটের সময়কালকে টাকা ইনকামের মৌসুম হিসেবে মনে করে।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কলিম উল্লাহ নির্বাচন নিয়ে তার অভিমতে বলেন, “এখন কেন্দ্র দখল বা পেশী শক্তি দিয়ে জয়ের চেয়ে প্রার্থীরা টাকার বিনিময়ে ভোট কিনে জয়ী হতে চান।একটি ভোট কিনতে পাঁচ শত থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে”।দলীয় প্রতিকে নির্বাচন করা নিয়ে দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ও টাকা লেনদেন সংক্রান্ত অনেক সংবাদ শুনতে পাওয়া যায়। । আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন যে, টাকা খেয়ে অযোগ্য প্রা্র্থীদের নাম কেন্দ্রে না পাঠানোর জন্য।আবার দেখা যায় অবৈধ টাকার মালিকগণ এখন সদম্ভে রাজনীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এক সময় মানুষ চুরি করে ঘুষ খেত।কালোবাজারি অবৈধ কারবার লোকচক্ষুর অন্তরালে করতো। আর দুর্নীতিবাজ বাবার অপকীর্তির জন্য তাদের ছেলেমেয়ে লজ্জিত থাকতো। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় বাবার অবৈধ টাকার ইনকামে ছেলে মেয়ে আনন্দ নিয়ে দিন যাপন করে। আর সমাজ নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে রাখার জন্য টাকা ছিটিয়ে নেতা হবার উচ্চ বিলাসী মনোবৃত্তিতে রাজনৈতিক চরিত্র কে কলুষিত করছে। যার পরিনামে সমাজিক অবক্ষয় দিনকে দিন নিম্নমুখী হচ্ছে।অযোগ্য, নীতিহীন মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসছে। ফলে দার্শনিক দৃষ্টিতে, ” অযোগ্য নেতৃত্ব নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন এক সাথে দেশের কাজে নামতে নেই।তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়”।

দেশপ্রেমের সারমর্ম হলো জনকল্যাণে ব্যক্তিগত স্বার্থের ত্যাগ।আগে দেশে রাজনীতিটা ব্যবসা হিসাবে বিবেচিত হতো না ।মানুষের মনে থাকতো সেবার মনোভাব।জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে মানুষের সেবা করাই মুখ্য ছিল। জনপদের উন্নয়ন, শিক্ষাবিস্তার সামাজিক মুল্যবোধ নিশ্চিত তথা বাস যোগ্য একটি সমাজ বিনির্মানে নিজেকে নিয়োজিত রাখতো।,একসময় অনেক জায়গা জমিনের মালিক ছিল। নিজের জমি বিক্রি করে জনসেবা করতে করতে নিজের জন্য কিছুই বাকি রাখেনি। এমন মানুষের উদাহরণ অনেক। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজকাল চরম দারিদ্র্য নিয়ে দিন যাপন করছে। কিন্তু তারা আলোকিত মানুষের কাতারে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছে। কারণ তারা নিজেদের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে পারে নাই। কিন্তু এখন অনেক রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যবসা হিসাবে মনে করে।রাজনীতিকে ব্যবসা হিসাবে দেখার কারণে রাজনীতিবিদদের মন থেকে উঠে যাচ্ছে সেবার মনোভাব। জনকল্যাণ মুলক কাজের অভ্যাস।কারণ টাকা দিয়ে কেনা ভোটে জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ পুঁজি তুলে আনা। তার পরে লভ্যাংশ।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামতে বলা হয়, নির্বাচনে টাকার খেলা বা ভোট বেচাকেনা চললে সত্যিকার অর্থে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না।এভাবে টাকা ছড়িয়ে যাঁরা নির্বাচিত হয় তারা নির্বাচনের পর তাদের বিনিয়োগ তুলতেই ব্যস্ত থাকে”।আবার অন্য ভাবে চিন্তা করলে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য ভোটার গন অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। ভোটার গন টাকা নিতে অস্বীকার করে থাকলে প্রার্থীরা টাকা নিয়ে ইলেকশনে আসতে সাহস হারাবে ।আবার সকল ভোটার গণ টাকা নিয়ে ভোট প্রদান করে থাকে তা সঠিক তথ্য নয়।মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ লোভ সামলাতে না পেরে টাকা খায়। তবে ভোটের সময় টাকা দেওয়া নেওয়া নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ঘিরে। যারা সুবিধাবাদী দালাল প্রকৃতির হয়ে থাকে। অকর্মা, লেজুড় মানষিকতায় দক্ষ এই শ্রেণির মানুষ প্রার্থীদের জয়ী করার সপ্ন দেখিয়ে ভোট কেনা-বেচা নিয়ে উৎসাহিত করে।অবৈধ টাকার মালিকগন নিজেকে সমাজ সেবক হিসেবে পরিচিত করার জন্য জয়ী হবার লক্ষ্যে গোপনে দালাল চক্র কতৃক টাকা নিয়ে মাঠে নামে। তবে তারা সব জায়গায় সফল হয় তা নয়, কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু অসাধু ভন্ড সমাজ সেবকদের কারনে পুরো প্রতিনিধিত্বশীল শ্রেণি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে । তবে প্রার্থীদের কাছ থেকে গৃহীত টাকা ভোটারদের হাতে পৌঁছে যায়, তার কোন নিশ্চয়তা থাকে না।কারণ টাকার কোন রশিদ থাকে না।তাই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে সব ভোটারদের টাকা খাওয়া ভোটার বলে মনে হয়।পরিনামে নির্বাচন পরবর্তী ভোটারদের গুরুত্ব কমে যায়।তবে জনগণ প্রার্থীর যোগ্যতা, শিক্ষা,সমাজ সেবা নিয়ে দুরদর্শিতার উপর নজর রেখে ভোট প্রদান করে, টাকা দেখে নয়।তাই অনেক ভোটারদের ভাষায়, “ভোট দেয় ভোটারে,টাকা খায় চিটারে।”,

প্রার্থী পছন্দে ভোটারদের সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। যোগ্যতা অযোগ্যতা নিয়ে কার ও কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে সঠিক সীদ্ধান্ত নিতে নিজের বিবেকের উপর আস্থা বুদ্ধিমানের কাজ । নির্বাচনকালীন সময়ে বহু কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায় । হুমকি, ধামকি থেকে প্রলোভন সহ হরেক রকম কৌশল অবলম্বন করে।একে অন্য প্রার্থীকে জব্দ করার জন্য। ব্রিটিশ অভিনেতা ফ্র্যান্ক ডেন এর মতে, “নির্বাচন হল যুদ্ধের মতোই ভয়াবহ। প্রথমটিতে মানুষ রক্তস্নাত হয়,আর দ্বিতীয়টিতে কাঁদায় মাখামাখি হবার মতো অবস্থা হয়”।কারণ, ” মানুষ আর কখনো এমন মিথ্যা কথা বলে না, যতটা তারা বলে থাকে শিকার করার পর বা যুদ্ধের সময় এবং নির্বাচন চলাকালে। “

ইউনিয়ন পরিষদ দোর গোড়ায় জনগনের সরকার। সাংবিধানিক ভাবে ইউনিয়ন পরিষদের উপর অনেক কাজ ন্যস্ত থাকে ।যা সব সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু পর্যাপ্ত ফান্ড এবং জনবলের কারণে সাংবিধানিক ভাবে প্রাপ্ত সব কাজ করে উঠা সম্ভব হয়ে উঠে না।স্থানীয় প্রশাসনের সাথে এক সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হয়। তাই শিক্ষিত দক্ষ বিচক্ষণ চেয়ারম্যান মেম্বার না হলে প্রশাসন থেকে আদায় করা সম্ভব হবে না। কালো টাকার খেলায় যেনতেন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসলে রাষ্ট্রের তৃনমুল পর্যায়ের মানুষদের ঘরের কাছের প্রতিষ্ঠানটি অকেজো হয়ে যাবে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দায়িত্ব শীলও শক্তিশালী করার মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা, সরকারের উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত এবং সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে। তাই নাগরিকদের ও নিজের অধিকার এবং স্বাধীনতার অবস্থান থেকে কালো টাকাকে না বলতে হবে।কারণ ভোট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। পবিত্র আমানত।ভোট দেওয়া নাগরিকদের মহান দায়িত্ব। জেনে বুঝে সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করা নাগরিক কর্তব্য।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কলামিস্ট, সাবেক ছাত্র নেতা।