সিবিএন ডেস্ক:
করোনায় যে ক্ষতি হয়ে গেলো বিশ্বের, সেটা সহজে পুষিয়ে নেওয়ার নয়। দৃশ্যমান ক্ষতির সঙ্গে যোগ হয়েছে অদৃশ্য মনের ক্ষতি। মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে উদ্বেগের বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভীতি, লকডাউন ও ঘরবন্দি জীবনের কারণে মানুষের মানসিক ঝুঁকি বেড়েছে অনেক। এরইমধ্যে আজ (১০ অক্টোবর) বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।

করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুগছেন এমন মানুষরা যদি সর্বোচ্চ চিকিৎসাও পান, তারপরও তাদের লক্ষণ থেকে যাবে।

সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারির প্রভাব মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা, সংক্রমণভীতি, পরিবারের সদস্য হারানোর দুঃখ—এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জীবিকা হারানোর ভয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের ৩২ শতাংশ জানিয়েছেন, মহামারির কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়েছে। ইতালি ও স্পেনে শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। কানাডায় ১৫-৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মদ্যপান বেড়েছে ২০ শতাংশ। এমনকি ইথিওপিয়াতেও মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বেড়েছে তিনগুণ।

এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রিচার্ড হর্টন এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে— তাকে সিনডেমিক বলা যায়। মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।’

এদিকে, দেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ ভীষণভাবে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলেছে।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের জরিপ অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। করোনাকালে ৪৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে। অথচ দুই বছর আগে একই প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল— প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক রোগের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। যার মধ্যে বিষণ্ণতার হার ছিল ছয় দশমিক সাত শতাংশ ও দুশ্চিন্তা ছিল চার দশমিক সাত শতাংশ।

আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে করোনাকালে আত্মহত্যা বেড়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, গত এক বছরে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৪ হাজার। করোনা নিয়ে কুসংস্কার ও কোভিড ভীতিতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি। এ ছাড়া করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও মানসিক চাপ বেড়েছে।

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড প্যানডেমিক মোকাবিলা করা যাবে। কিন্তু এর প্রভাবে যে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ আসবে, সেটা হবে মানসিক স্বাস্থ্যের মহামারি। বহু মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হবেন। অনেকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগবেন।

চীনের উহান, ইতালি এবং নিউইয়র্কে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে পিটিএসডি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

যুদ্ধ, মহামারি বা যেকোনও বড় বিপর্যয়ের পর এমনটা হয় বলে মন্তব্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, জীবনে প্রতিটি মানুষই কোনও না কোনও সময় হতাশা, বিষণ্নতা বা মন খারাপের মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু করোনার আগে এসব বিষয় নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার উদাহরণ ছিল না। করোনায় এ বিষয়টি বদলে গেছে। মানুষ এত বেশি ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে তাকে চিকিৎসকের কাছেও যেতে হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষ কাজে পিছিয়েছে। অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে। পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে। অনেকের চাকরি চলে গেছে। এ সবই মনের ওপর প্রভাব ফেলেছে।’

তিনি আরও বলেন, যারা শারীরিকভাবে করোনায় আক্রান্ত হননি, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মনের দিক দিয়ে।

‘প্রতিটি গ্রুপের আলাদাভাবে ক্ষতি করেছে করোনা। এর পরিমাপ করা যাবে না।’ বললেন ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “করোনাকালে মানসিক রোগে ভোগা রোগী বৃদ্ধির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগীদের ‘ভ্যারিয়েশন’-এ পরিবর্তন হয়েছে। রোগীরা আগে যে মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতো না সেসব সমস্যা নিয়েই এখন আসছেন বেশি।”

‘শিশুদের মধ্যে আচরণজনিত সমস্যা বেড়েছে বেশি— এটা আমাদের গবেষণাসহ হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারেও পাচ্ছি।’ এমনটা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এটা বেশি হচ্ছে ১০-১১ ও ১৮-১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে। এসব শিশু-কিশোররা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করছে। আবার বাবা-মায়ের অভিযোগ হচ্ছে, সন্তান কথা শোনে না, ঘুমের সময় বদলে গেছে। ডিভাইস আসক্তি বেড়েছে।’

করোনা হলে চিকিৎসা পাওয়া যাবে কিনা কিংবা আপনজনের মৃত্যু— এসব নিয়েই মানসিক রোগের শুরু জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে আচরণ ও সামাজিকতায় পরিবর্তন এসেছে। এর সঙ্গে মানাতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে সবাইকে। এসব কারণেই মানসিক রোগ বেড়েছে।’