বাংলা ট্রিবিউন:
সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)-এর নেতৃত্বে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচআর)-এর চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুহিবুল্লাহ পরিচিত মুখ হওয়ায় কয়েকবারই তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল আরসা। তবে আদর্শগত পার্থক্য থাকায় এক হতে পারেনি দুই সংগঠন। দিনে দিনে বেড়েছে শত্রুতা। সশস্ত্র হওয়ায় বিরুদ্ধমতকে সবসময় শক্তি দিয়েই দমানোর চেষ্টা করেছে আরসা। তারই ধারাবাহিকতায় মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা সাধারণ রোহিঙ্গাদের।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুহিবুল্লাহর সমর্থক বেশি ছিল। তবে আরসার হাতে অস্ত্র থাকায় তাদের ভয়ে কোণঠাসা থাকতো মুহিবুল্লাহর অনুসারীরা। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, মুহিবুল্লাহর দাবি ছিল, মিয়ানমারে যারা প্রকৃত গণহত্যার শিকার ও শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছে তাদের মধ্যেই কেউ নেতৃত্ব দিক। তাই আরসার প্রস্তাব নাকচ করেন তিনি। এ নিয়েই আরসা ও মুহিবুল্লাহর দ্বন্দ্ব শুরু।

‘হতে পারে এটাই আমার শেষ আওয়াজ’
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক রোহিঙ্গা নেতাকে হোয়াটসঅ্যাপে অডিও বার্তা দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকায় রোহিঙ্গারা সাধারণত হোয়াটসঅ্যাপে সরাসরি কল না করে কথা রেকর্ড করে বার্তা আদান-প্রদান করে। মুহিবুল্লাহর এমন কয়েকটি অডিও বার্তা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আরসার কার্যক্রম নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তিনি।

একটি বার্তায় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ক্যাম্পের ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ আমাকে সমর্থন করে। আমার সঙ্গে তারা কাজ করে। কিন্তু ৫ ভাগ মানুষ তাদের (আরসার) সঙ্গে রয়েছে, তারা ক্যাম্পে মানুষ খুন, মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত। তারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের শান্তিতে থাকতে দেয় না। যারাই তাদের বিপরীতে যায়, তাদের ধরে নিয়ে যায়। আমি তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছি। তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আমি জানি না, আমার কখন মৃত্যু হবে। আমার শেলটারে আমি আছি। অনেকবার আমাকে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আরসার সদস্যরা আমাকে যেকোনও সময় মেরে ফেলতে পারে। হতে পারে এটাই আমার শেষ আওয়াজ (কথা)।’

অপর একটি অডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘কমিউনিটি ভিত্তিক যেসব সংগঠন রয়েছে, তাদেরও আরসা দলে ভেড়াতে চায়। তাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে। হুমকি দেয়। এসব কারণে অনেকেই ভয়ে রয়েছে।’

অডিও বার্তাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সংগ্রহ করেছেন। তারা মুহিবুল্লাহর বক্তব্য যাচাই করে দেখছেন।

আদর্শগত পার্থক্য:
শুরু থেকেই আরসা বিতর্কিত সংগঠন। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় করতে চায়। মুহিবুল্লাহ চাইতেন রোহিঙ্গাদের এই সংকট রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কূটনীতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে হোক। যাতে রোহিঙ্গারা অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারে। এই আদর্শগত পার্থক্যের কারণেই আরসার সঙ্গে হাত মেলাননি মুহিবুল্লাহ।

মুহিবুল্লাহর অনুসারীরা আরও জানিয়েছেন, মুহিবুল্লাহ কখনও সশস্ত্র আন্দোলনের কথা ভাবেননি। শান্তিপূর্ণভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবার কথা বলতেন।

সাধারণ রোহিঙ্গারা যেভাবে দেখছেন এই হত্যাকাণ্ড:
মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর সাধারণ রোহিঙ্গাদের অনেকে ভেঙে পড়েছেন। নেতৃত্ব সংকটে পড়েছেন তারা। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে তারা আশা দেখেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর এখন তারা ভীত।

রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন এক ব্যক্তি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আরসার চাঁদা ওঠানোর কাজে বাধা দিতেন মুহিবুল্লাহ। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও কূটনীতিকদের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর সুসম্পর্ক ছিল।’

এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘যারা চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাক, তারাই আরসাকে দিয়ে এমনটা ঘটিয়েছে। কারণ আরসা চায় তারা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজী চালিয়ে যাবে, রোহিঙ্গাদের শাসন করবে। আরসার সদস্যরা অনেক নিরীহ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। ২০১৭ সাল থেকে তারা প্রায় ৭০-৮০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া অনেককে তুলে নিয়ে গেছে।’

কেন রোহিঙ্গারা আরসাকে চায় না?
২০১৭ সালের প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের কাছে আরসা কিছুটা জনপ্রিয়তা পেলেও এখন তা তলানিতে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাইলে আরসার বিরুদ্ধেই বলেন তারা। তারা মনে করেন, আরসা তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে না, মিয়ানমারের একটি পক্ষের হয়ে কাজ করছে।

জাহাঙ্গীর নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘তারা ভালো চাইলে রোহিঙ্গাদের মতামত নিয়ে কাজ করতো। তা তারা করে না। মিয়ানমার যখনই আলোচনায় বসে, যখনই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই আরসা আরাকানে হামলা চালিয়ে বসে। এগুলো কেন হয়? রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য? নিশ্চয়ই নয়।’

যেভাবে তৈরি হলো আরসা:
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, আরসা মূলত গড়ে উঠেছিল সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দিয়ে। মক্কায় থাকে এমন ২০ জন রোহিঙ্গা সংগঠনটি গড়ে তোলে। তারা বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে।

সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ (আবু আমর জুনুনি নামেও পরিচিত)। তার বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচিতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। ২০১২ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হন আতাউল্লাহ। এরপর ২০১৭ সালে আরাকানে হামলার পর তার নাম আবার চাউর হয়।

বিদেশে সৃষ্ট এই সংগঠন রোহিঙ্গাদের তেমন একটা টানে না। তাছাড়া তাদের সাংগঠনিক কাঠামোও দুর্বল।

ইউনুস আরমান নামের এক তরুণ রোহিঙ্গা বলেন, ‘সশস্ত্র হয়ে আরসা রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী জাতিতে পরিণত করতে চায়। আমরা এভাবে অধিকার আদায় করতে চাই না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেই তারা বাধ্য হবে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি জাতিসংঘ এ সমস্যা সমাধানে কিছু করতে না পারে, তবে আমাদের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্পের সন্ত্রাসীদের জন্য নিরীহ রোহিঙ্গাদের এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।’

গ্রেফতার ১০ জন রিমান্ডে:
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এর মধ্যে ৩ অক্টোবর দুই সন্দেহভাজন মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ প্রকাশ, লম্বা সেলিম (৩৩) ও শওকত উল্লাহ (২৩) নামের দুই রোহিঙ্গা গ্রেফতার হয়। ৬ অক্টোবর হয় তিনজন—জিয়াউর রহমান, আব্দুস সালাম ও মো. ইলিয়াস। ৯ অক্টোবর গ্রেফতার পাঁচজন হলো — খালেদ হোসেন (৩৩), সৈয়দ আমিন (৩৮), শাকের (৩৫), মোহাম্মদ কলিম (১৮) এবং মো. ইলিয়াস (২২)। তারা সবাই পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ১৪-এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক জানান, ‘আটক ব্যক্তিরা ক্যাম্প এলাকায় আরসা সংগঠনের নামে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল। তাদের উখিয়া থানায় পুলিশের কাছে হস্তান্তার করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল অস্ত্রধারী। এ ঘটনায় নিহত মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে উখিয়া থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।