গুলিবিদ্ধ সিনহা’র ছবি উঠালে পুলিশ মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় : সার্জেন্ট আইয়ুব

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:৫৯

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ছবি : বাম থেকে পিপি এড. ফরিদুল আলম, মাঝে সাক্ষী, আরএমও ডা. শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী ও ডানে অতিরিক্ত পিপি এড. মোজাফফর আহমদ হেলালী।

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করার খবর পেয়ে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত ১০’১৫ থেকে ১০’২০ মিনিটের দিকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে তাৎক্ষণিক বাহারছরা শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে যায়। সেখানে গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু অবস্থায় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে দেখতে পেয়ে তার ছবি তুলি। সেখানে থাকা ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দ দুলাল রক্ষিত সহ অন্যান্যদের দেখতে পাই। ঘটনার বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চায়। তাদেরকে নিজের পরিচয় দিই। এরপর তারা চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। ছবি উঠানো আমার মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। ঘটনাস্থল থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয়।

চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার সাক্ষী, সেনা সদস্য সার্জেন্ট আইয়ুব আলী আদালতে জবানবন্দী প্রদানকালে এসব বক্তব্য দেন। তিনি হলেন-এ মামলায় জবানবন্দী দেওয়া ১২তম সাক্ষী। বুধবার ২২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে তিনি এ জবানবন্দী দেন।

ঘটনার সময় সেনা সদস্য সার্জেন্ট আইয়ুব আলী শামলাপুর আরপি চেকপোস্টে কর্মরত ছিলেন। সার্জেন্ট আইয়ুব আলী তার জবানবন্দীতে আরো বলেন, ঘটনাস্থল এপিবিএন চেকপোস্টে তিনি সিফাতকে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান এসএসএফ-এ দায়িত্ব পালন করাকালীন পরিচিত মুখ হওয়ায় তাঁকে সার্জেন্ট আইয়ুব আলী সহজে চিনতে পারেন। পরে ‘ছারপোকা’ নামক পিকাপে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের লাশ পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দ দুলাল রক্ষিত ও অন্যান্যরা বাহারছরা পুলিশ ফাঁড়িতে যায়। সেখানেও আমাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। বাইরে দাড়িয়ে থাকি। সেখানে কিছু আলামত সাজিয়ে রাখা হয়। যেসব আলামত, মাদকদ্রব্য বা অবৈধ পণ্য ঘটনাস্থলে দেখিনি। সেখানে তিন জন লোক দেখতে পায়।পরে জানতে পারি তারা- শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

এসব খবর আমার কাছে থাকা দ্বিতীয় আরেকটি মোবাইল ফোনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে কিছুক্ষণের মধ্যে লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর আরেফিনের নেতৃত্বে ২ পিকাপ ও ১ জীপ সৈন্য রামু সেনানিবাস থেকে বাহারছরা পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে আসে। লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর আরেফিন স্যারের সাথেও পুলিশ উচ্চ স্বরে চরম দুর্ব্যবহার করে। লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর আরেফিন স্যার বার বার পুলিশকে থামাতে চেষ্টা করেন। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর আরেফিন স্যারকে বলেন, আপনি চলে যান, কেন বার বার আমাদের কাজে বাঁধা দিচ্ছেন? কাজ শেষে সব জানতে পারবেন। তখন আসামী প্রদীপ কুমার দাশ মোবাইল ফোনে অন্য প্রান্তের একজনকে বলতে থাকেন- “সেনাবাহিনীর জন্য এখানে কাজ করতে পারছিনা”।

সার্জেন্ট আইয়ুব আলী (৪৩), সিরাজগঞ্জের খোপসাবাড়ির দিয়ার পাছিল গ্রামের মৃত সানোয়ার হোসেনের পুত্র। তিনি রামু সেনানিবাসে কর্মরত।

একইদিন বুধবার মামলার ১৩ তম সাক্ষী কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী, ১৪ তম সাক্ষী বাহারছরার মারিশবনিয়া গ্রামের অলি আহমদের পুত্র মোক্তার আহমদ (৩২) এর আদালতে সাক্ষ্য দেন ও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা তাদের জেরা করেন।

রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটির আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট মোজাফফর আহমদ, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণ করেন। এসময় বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এর আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা, এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট মাহবুবুল আলম টিপু, এডভোকেট ফারহানা কবির চৌধুরী, এডভোকেট মোহাম্মদ ছৈয়দুল ইসলাম, এডভোকেট এসমিকা সুলতানা প্রমুখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আসামীদের পক্ষে আদালতে এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, এডভোকেট দিলীপ দাশ, এডভোকেট শামশুল আলম, এডভোকেট মমতাজ আহমদ (সাবেক পিপি) এডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া, এডভোকেট চন্দন দাশ, এডভোকেট এম.এ বারী, এডভোকেট নুরুল হুদা, এডভোকেট ওসমান সরওয়ার শাহীন, এডভোকেট মোশাররফ হোসেন শিমুল, এডভোকেট শিপন দে, এডভোকেট ইফতেখার মাহমুদ প্রমুখ সাক্ষীদের জেরা করেন।

এর আগে বুধবার সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে আাসামী প্রদীপ কুমার দাশ এর নিয়োজিত আইনজীবী এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিষয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স-ডিজিএফআই) তৈরি করা প্রতিবেদন ও ডকুমেন্টস আদালতে তলব করে এনে মামলার মূল নথীর সাথে সংযুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল আবেদনটি শুনানি করে বিষয়টি জুডিয়াসিয়ারী বিষয় না হওয়ায় আবেদনটি নাকচ করে দেন।

এর আগে আরো ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করা হয়। যাঁরা আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা হলেন-মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস, সাক্ষী সাহিদুল ইসলাম সিফাত, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ আমিন, মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও হাফেজ শহীদুল ইসলাম, আবদুল হামিদ, ফিরোজ মাহমুদ ও মোহাম্মদ শওকত আলী, হাফেজ জহিরুল ইসলাম, ডা. রনধীর দেবনাথ।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার এম. নুরুল কবির জানান-সোমবার ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানা ৩ দিন সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য চার্জশীটের ২৯ নম্বর পর্যন্ত আরো মোট ২৩ জন সাক্ষীকে সমন দেওয়া হয়েছিলো। তারমধ্যে প্রতিদিন ৪ জন করে সাক্ষী আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। সাক্ষীরা যথারীতি আদালতে উপস্থিত থাকলেও আসামীদের পক্ষে সাক্ষীদের দীর্ঘ জেরার কারণে সমন দেওয়া সকল সাক্ষীদের সাক্ষ্য নির্ধারিত দিনে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানান-এপিপি ও কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ।

সাক্ষ্য গ্রহণকালে মামলার ১৫ জন আসামীকেও কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করা হয়। মামলায় কারাগার থেকে এনে আদালতে যে ১৫ আসামিকে হাজির করা হবে, তারা হলো : বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া।প, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

গত ২৩ আগস্ট সকালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।