– নাজনীন বেগম

অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র বাঙালির মন ও মননে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখেন তা এখনও সময়ের প্রজন্মকে নানা মাত্রিকে উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। জন্মের প্রায় ১৪৩ বছরেও হরেক রকম সামাজিক বিবর্তন, আধুনিক সমাজের যৌক্তিক আবেদন, যুগ ও কালের সমৃদ্ধ আঙিনা সব কিছুকে ছাপিয়ে এই মহান সৃজন ব্যক্তিত্ব এখনও বাংলার ঘরে ঘরে পাঠক প্রিয়তার অবস্থানকে প্রতিনিয়তই শাণিত করছেন। জন্ম ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। নবজাগরণের সুবর্ণ সময়ই শুধু নয় উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের জ্ঞানী-গুণীর মহাসম্মিলনের যুগসন্ধিক্ষণে শরৎ চন্দ্রের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় পর্ব। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আধুনিক প্রতিবেশে সমকালীন অঙ্গনে রক্ষণশীলতার সামাজিক আবর্জনা পেছনে ফেলে সামনে চলার দৃঢ় প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও সমাজের সর্বক্ষেত্রে তার নতুন আলো বিকিরণ করতে আরও কয়েক যুগ পার হতে হয়। চলে আসা দীর্ঘ সামাজিক অভিশাপ জগদ্দল পাথরের মতো মূল শেকড়ে এমনভাবে চেপে বসে শত আঘাতেও তাকে যথার্থভাবে ভেঙ্গে ফেলতে সময়ের পর সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে। রাজা রামমোহন আর বিদ্যাসাগর যে আধুনিক চৈতন্যে সমাজকে নতুন পথ দেখাতে উদ্দীপকের ভূমিকায় নামলেন সেখানে বাংলার আরেক নবজাগরণিক পথিকৃৎ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নতুন ভাব পরিসরকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে সংস্কারাচ্ছন্ন সনাতনী পন্থাকে নতুন মোড়কে উন্মোচন করলেন। উপমহাদেশীয় প্রথম  স্নাতক অর্জনকারী এই কৃতিপুরুষ সাহিত্যিক অঙ্গনেও নতুন সৃষ্টির ঝড় তুললেন। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের জগতকে শুধু উন্মোচনই করলেন না এখনও সেখানে তিনি অনন্য আসনে ভূষিত। সাহিত্য স¤্রাট আধুনিকতার বলয়ে নিজের সৃজন ক্ষমতাকে উৎসর্গ করলেও গতানুগতিক রক্ষণশীল সামাজিক অবয়বের নতুন কোন যাত্রাপথকে সেভাবে অবারিত করেননি। এদেরই পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের অবিস্মরণীয় সৃজন ক্ষমতা নিয়ে যে সমৃদ্ধ বিশ্ব সবাইকে উপহার দিলেন তা শুধু বিস্ময়ের নয় এক আকা*িক্ষত সাহিত্যিক বলয়ের স্বপ্নাবিষ্ট আঙিনার নিরন্তর শুভযাত্রার অভাবনীয় অভিগমন। বাংলা সাহিত্যের নতুন যুগকে যিনি অবারিতও বিশ্বসভায় অভিষিক্ত করালেন সেখানে তিনি তাঁর অগ্রজদের সম্মান ও মর্যাদাই দেননি তারচেয়ে বেশি মনন ও সৃজনকর্মে তাঁদের আলোকিত জগতকেও সাহিত্যের অনুগামি করেছে। চেতনা ও মননে বিদ্যাসাগরকে পূজা করেছেন আর সৃজন দ্যোতনায় বঙ্কিম চন্দ্রকে বিভিন্ন ভাবকল্পনায় অবারিতও করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ এ নতুন ধারাটির যাত্রা শুরু করে যে দ্যুতি ছড়ালেন পরবর্তী অনুজরাও সেই আলোর দ্যুতিকে আরও ছড়িয়েও দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ১৫ বছর পরে আর এক যুগস্রষ্টা কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাবই শুধু নয় আপন আলোয় নিজস্ব পথ চলারও এক অভাবনীয় নবদীপ্তি। শরৎ চন্দ্র কবিতা ছাড়া সাহিত্যের বিভিন্ন আঙিনায় সদর্পে পদচারণা করে আজ অবধি আপন স্বকীয়তায় নিজের অবস্থানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে পৌঁছে দিচ্ছেন।

নবজাগরণীয় ভাব সম্পদে উনিশ শতকের মাঝামাঝি যে নবজাগৃতির ধারা সূচিত তা মূলত অভিজাত শ্রেণী এবং একটি বিশেষ সামাজিক বলয়ে আটকে থাকে। ফলে জাতি ভেদ, ধর্ম আর বর্ণের বিভাজনই শুধু নয় নারী-পুরুষের অসম আর বৈষম্যে গোটা সমাজ তখনও পশ্চাদপদ এবং দ্বিধাবিভক্ত। এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া শরৎ চন্দ্র অতি বাল্যকাল থেকে আর্থিক অসচ্ছলতায় মাতুলালয়ে বড় হওয়ার কাহিনী বিধৃত আছে। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা ভুবন মোহিনীর ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ভুবন মোহিনী তার স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে পৈত্রিক ভিটায় থাকতেন বলে জানা যায়। ব্রাহ্মণ ঘরের। সন্তান হয়েও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বর্ণাশ্রম প্রথাকে যে মাত্রায় আঘাত করেছেন বাংলা সাহিত্যে তেমন আখ্যান সত্যিই বিরল। শুধু ধর্ম কিংবা বর্ণ নয় বিত্তের ফাঁরাকও যে মানুষে মানুষে পাহাড় সমপ্রাচীর তৈরি করে তেমন সামাজিক দগ্ধতার চিত্রও সাহিত্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। অগ্রজদের অনেক ধ্যান-ধারণাকে দর্পভরে অতিক্রম করে সর্ব মানুষের মিলন সুরকে যেভাবে উজ্জ্বল করেছেন সময়ের দাবিতে আজও তার গ্রহণযোগ্যতা কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়নি। ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত আর বিভেদের কঠিন নিগড়ে অসহায় ও পশ্চাদপদ গোষ্ঠীর যে অবর্ণনীয় সংগ্রামী জীবন তাতে শরৎ চন্দ্রের উদ্বিগ্ন আর উৎকণ্ঠের যথার্থ চিহ্ন তার সৃজন দ্যোতনায় মূর্ত হয়ে আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বচ্ছন্দ মিলনকে সামাজিক অপসংস্কার যে মাত্রায় বিদ্ধ করে সেখানে বিদ্রোহের চেতনায় নিজের সৃজন ও মনন শক্তি অবারিত করতে কখনও কুণ্ঠিত হতেন না। শুধু তাই নয়, যাপিত জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবের সুখ-দুঃখের যে অভাবনীয় অনুরণন সেখানেও এই অপরাজেয় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব নিজেকে অসাধারণ শৈল্পিক মর্যাদায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যক্তি মানুষের আকা*ক্ষাও স্বপ্নের সঙ্গে সমাজ সংস্কারের বিরোধ, দ্বন্দ্ব সংশ্লিষ্টদের কোন অশুভ সঙ্কেতের বিপন্নতার শিকার করে তারও বিদগ্ধ চিত্র তার সৃষ্ট শৈল্পিক সুষমার অনবদ্য উপস্থাপন। সমকালীন আবর্জনাকে আঘাত করতে গিয়ে নতুন দিগন্তকে অবারিত করার যে অদম্য চেতনা সেখান থেকে আজও সময়ের জয়ধ্বনি আধুনিক প্রজন্মকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।

১৯৮২ সালে উদীয়মান কিশোর ন্যাড়ার শরৎ চন্দ্রে ডাকনাম প্রতিদিনের জীবনযাত্রার হরেক রকম টানপোড়েনের দুঃসময়ে ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটো গল্প রচনার মধ্য দিয়ে তার লেখকসত্তার শুভ সংযোগ হলেও পরবর্তী সময়ে সেটা কয়েক বছর চাপা পড়ে থাকে। সাধারণ ঘরের সন্তান হয়ে জন্ম নেয়ার দুর্ভাগ্য তাকে কখনও রেহাই দেয়নি। অবভিক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়ানো এই অমর কথাশিল্পী শেষ অবধি ম্যাট্রিক পাস করেন ১৮৯৪ সালে। এর পরে কলেজে ভর্তি হলেও জীবনটা চলে অস্থির সময়ের এক অনিবার্য দোলাচলে। কলেজে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দিতে পারেনি অর্থের অভাবে। বেকার শরৎ চন্দ্র খেলাধুলা ও অভিনয় জগতেও কিছু সময় পার করেন। এভাবে জীবন থেকে অনেকটা বছর কেটে যায় হরেক রকম কর্মদ্যোতনায়। কোন এক সময় বাংলা ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় বার্মা থেকে রেঙ্গুনে। জীবনের এমন সব পালাক্রমে সৃজন ক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকে। শুরু থেকেই সৃজন শক্তিকে শাণিত করতে হয় সমাজ ব্যবস্থার শেকড়ে প্রোথিত কঠিন অপশক্তি আর সংস্কারের বিরুদ্ধে। মানুষের নিজের তৈরি করা কঠিন নিয়মবিধিকে অত্যন্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে বিশ্লেষণ করে যেভাবে খগ্ড় হস্ত হয়েছেন তেমন সমাজ কাঁপানো বলিষ্ঠ উচ্চারণ পুরো অঙ্গনের ওপর এক সাঁড়াশি আক্রমণ। দুঃসাহসিক মনোবলে, অজেয় মনন দ্যোতনায় যে মাত্রায় সামাজিক নিপীড়নকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন বাংলা সাহিত্যে তা আজও এক অনন্য নজির। অতি সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া অসাধারণ মননশৌর্যে শরৎ চন্দ্র শুধু তার সময়ের নায়ক হলেও বছরের পর বছর সময়ের প্রজন্মের চিরায়ত উদ্দীপকের জায়গায় নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিলেন। আজও সেখানে তিনি অবিচলই শুধু নন প্রতি যুগ ও কালের সামাজিক অপসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়ানো অপরাজেয় শৈল্পিক ব্যক্তিত্বও। সৃজন পথপরিক্রমার শতবর্ষ পার হয়েও আধুনিক প্রজন্ম এখনও তার বড় দিদি, মেজ দিদি, বামুনের মেয়ে, নিষ্কৃতি, আভাগীর স্বর্গ থেকে দেবদাস, পরিণীতা, গৃহদাহ, দত্তার সঙ্গে পথের দাবির যে আবেদন পাঠকদের মাঝে সাড়া জাগায় তা আরও কত বছর নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করবে তার জবাব সময়ের কাছে। শুধু কি সামাজিক অপসংস্কার? দৈনন্দিন জীবনের মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকা*ক্ষা, প্রীতির বাঁধন, সাংসারিক কলহ বিবাদ নারী জাতির নিপীড়ন ও

বঞ্চনাকে যেভাবে শৈল্পিক শৌর্যে মহিমান্বিত করেছেন সেখানে এক দক্ষ সমাজ সংস্কারের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই কথা অনস্বীকার্য লেখনী শক্তি, সমাজ সচেতনতাকে স্পর্শ করতে না পারলে আবেদন ক্ষণস্থায়ী। সমকালীন বোধ আর অভিব্যক্তিকে মূল চেতনায় ধারণ করে যুগ ও কালকে চিরস্থায়িত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে ব্যর্থ হলে গল্পের চাহিদা তার আবেদনকে হারাতে বসে। সে মাত্রায় নির্মাতাও পাঠকদের কাছ থেকে দূরে সরে যান। আর যদি তিনি সময়ের আবেদনে জীবন ও জীবিকার চিরন্তন বোধগুলো প্রতিনিয়তই শাণিত করতে পারেন তাহলে তিনি শুধু তার কালকেই জয় করেন না তার চেয়ে বেশি ভাবী কালকেও অবারিত করতে সময়ের জয়গান গেয়ে যান। আর সেখানে তার পাঠকপ্রিয়তারও কোন ঘাটতি হয় না। ¯েœহ আর মায়া মমতার বাঁধনে জীবন ও সংসারের যে সাবলীল গতি ধারা সেখানে সম্পর্কের গূঢ় মর্মকেও সাহিত্যের গভীরে অনুপ্রবেশ করানো শরৎ চন্দ্রের অবিস্মরণীয় সৃষ্টির মহিমা। স্নেহ -ভালবাসার আধারে পরিপূর্ণ সাংসারিক জীবন প্রতিটি মানুষের আত্মিক বন্ধনের যে অনুপম দ্যোতনা তা বিভিন্ন চরিত্র বিশেষ করে নারীর মহিমা রূপায়ণে অন্যভাবে আলোকিত, পরিস্ফুুট। সমকালীন অঙ্গনে রামমোহন কর্র্তৃক প্রবর্তিত ব্রাহ্মণধর্মও বিভিন্ন ভাবে সমাজ তার প্রভাব বিস্তার করলে সাহিত্যিক আঙিনায়ও ছায়া ফেলতে সময় নেয়নি। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সৃজন কর্মে তা যেমন স্পষ্ট একইভাবে শরৎ চন্দ্রের সাংস্কৃতিক কর্মযোগেও তার চিহ্ন পড়তে সময় লাগেনি। বাংলা ও বাঙালীর বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতে শরৎ সাহিত্যের যে অভাবনীয় যুগ পরিকল্পনা সেখানে বিশাল শৈল্পিক সক্ষমতায় বিভিন্ন চরিত্রের যথার্থ রূপকার এই অমর কথাশিল্পীর অতুলনীয় সম্পদ আজও পাঠকদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে। বর্তমানের আধুনিক প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারিত বিশ্বে উনিশ থেকে বিশ শতকীয় মনন নায়কদের আবেদন-নিবেদনে আজও পরিপুষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিশেষভাবে অনুপ্রাণিতও। ফলে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যিক ধারা তার নির্দিষ্ট বলয়কে অতিক্রম করে যুগ ও সময়ের আবেদনকে আরও জোরদার করছে সেখানে শরৎ চন্দ্রের সৃষ্টি সম্ভার এক অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত। বড় দিদি থেকে বৈকুণ্ঠের উইল অবধি কত ধরনের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক তার সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে উদ্ভাসিত করেছে যে কিরণ আজও বাংলার সাহিত্য গগনের উজ্জ্বল নক্ষত্র শরৎ চন্দ্রের অভাবনীয় ভাব সম্পদ। শুরুতেই বলেছি কবিতা লেখেননি। সে সম্পর্কে অমর সাহিত্যিকের নিজস্ব অভিমতও উল্লেখ করার মতো। তাঁর মতে ছন্দোবদ্ধ কবিতার জন্য ভাবের আকাশে ভেসে বেড়াতে হয়। আর তিনি স্বচ্ছ নীল আকাশে প্রিয়ার কেশরাশি কখনও প্রত্যক্ষ করেননি। নিরেট, স্পষ্ট আর বাস্তব আকাশ তার সামনে শুধু আকাশ হয়েই মূর্তমান। তাই কাল্পনিক স্পর্শকাতরতার অভাবে কবিতা লেখা কখনও হয়ে ওঠেনি। কবিতা লেখেননি ঠিকই কিন্তু বাংলার জনপদের সাধারণ মানুষের চিত্র আঁকতে গিয়ে প্রকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনের গীতিময়তাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তা না হলে ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’ কিংবা ‘দেবদাসে’র মতো প্রেমের আখ্যান আজও ভালবাসার মানুষদের আন্দোলিত করতে পারে? ভালবাসার নির্মোহ চেতনায় ত্যাগ-তিতিক্ষায় উৎসর্গিত জীবন শুধু নিরেট বাস্তবতার আলোকে হতে পারে না। সেখানে সূক্ষ্ম জীবন দর্শন ও মায়া মমতার নির্ভেজাল হৃদয় দ্যোতনা তার সঙ্গে সম্পর্কের বিচিত্র রূপসম্ভার সেও তো কাব্য কাহিনীকে ছাড়িয়ে যায়।

মহেশের মতো ছোটগল্পের আবেদন যে চিরকালের সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। হতদরিদ্র পশুপালক গফুরের মর্মবেদনাই শুধু নয় কন্যা আমেনার মহেশের প্রতি নিবিড় মমত্ববোধের যে পরিচয় শরৎ চন্দ্রের শৈল্পিক শৈলিতে ফুটে ওঠে তেমন দুর্ভিক্ষের আকাল একবিংশ শতাব্দীতেও পাওয়া দুষ্কর নয়।

‘গৃহদাহে’র মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টিসম্ভার। ত্রিভুজ প্রেমের এমন সাবলীল গতি আর পরিণতিতে পাঠক সমাজ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে কোথায় গিয়ে মহিম, অচলা আর সুরেশের পরিণতি সুনির্দিষ্ট হবে। সেই সাধারণ কাহিনীতে মহিম-অচলার সম্পর্ক তৈরি, ভালবাসার বাঁধন পরবর্তীতে শুভ পরিণয়ের অনিবার্যতার গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লীতে তাদের সংসার জীবন বয়ে চলা। অতি স্বাভাবিক এক কাহিনীকে অসাধারণভাবে অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া দক্ষ নির্মাতার অভাবনীয় রূপশৌর্য। মাঝপথে মহিমের বন্ধু সুরেশের আবির্ভাবই শুধু নয় তাদের সংসারে অনধিকার প্রবেশও। ১৯২০ সালে রচিত এই উপন্যাসটিতে মহামারী আকারে প্লেগের প্রাদুর্ভাব সে সময়ের এক বিপত্তি আর অস্থিরতার পরিবেশ। তেমন দুর্যোগ সামলানোর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সুরেশ মানুষের দুঃসময়ে পাশে থাকার এক অনির্বাণ দীপ্তি। অদ্ভুত এক বিচিত্র চরিত্র। মানুষের জীবন রক্ষার্থে নিজের প্রাণ সংশয়কে তোয়াক্কা না করার যে বেপরোয়া মঙ্গল শক্তি সুরেশ তারই যথার্থ প্রতিনিধি। আবার সেই সুরেশ যখন বন্ধু আর তার স্ত্রীর জীবনকে ভাঙ্গনের শেষ ধাপে নিয়ে যায় সেখানেও সে উদ্ধত, উদভ্রান্ত, দিশেহারা এক অশুভ অপকৌশলের ধারক। কি যথার্থভাবেই না মনোসমীক্ষকের মতো সুরেশের দ্বৈত সত্তার নিবিড়তায় তার চরিত্রের ছন্নছাড়া ব্যাপারটিকেই মূর্ত করতে শরৎ চন্দ্রের শৈল্পিক শৈলী নানামাত্রিকে আন্দোলিত হয়। বিপাকে পড়ে অচলার মতো শান্ত, ¯িœগ্ধ, স্বামীর প্রতি নিবেদিত এক অসহায় নারী অচলা। স্বামীকে অন্তর দিয়ে ভালবেসেও সুরেশের সাময়িক ও ক্ষণিক উত্তেজনার অংশীদার হতে বিভ্রান্তির আবর্তে চলে যায়। অত্যন্ত দক্ষ হাতে গল্পের নির্মাতা তার চরিত্র সৃষ্টিতে যে মনোসংযোগ করেন সেখানে সৃজন ক্ষমতা সমস্ত চিন্তা-চেতনাকে অতিক্রান্ত করে যায়। অত্যন্ত সতর্কতায় মহিমকে তার মর্যাদা থেকে সামান্যতম সরান না তার স্রষ্টা। টানাপোড়েন চলে সুরেশ আর অচলার মধ্যে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ধারক মহিমের মতো চরিত্র আজও আমাদের সমাজকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। আর সুরেশের মতো কিছু অবিবেচক মানুষও সমাজের জন্য আশা-নিরাশার সঙ্কট নিয়ে সংসার আর সংস্কারে উদ্ধতভাবে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। প্রতি যুগ, সময় ও কালে বিচিত্র চরিত্রের মানুষের উপস্থিতিতে সমাজ-সংস্কারের ভিত্তি গ্রথিত হয়, পরিবার ও সংসারে হরেক রকম বিপত্তি মানুষের সম্পর্কের ভিত নাড়িয়ে দেয়, বিশৃ*খল আর অস্থিরতায় অনেকের জীবন অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ হয়। এমন বাস্তব আর চিরস্থায়ী সম্পর্কগুলো কোন নির্দিষ্টকালে সীমাবদ্ধ থাকে না। সময়ের মিছিলেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যায় না। সঙ্গত কারণে তেমন চমৎকার চরিত্রের নির্মাতারাও পাঠকপ্রিয়তাকে সার্বজনীন আর চিরন্তন আবেদনে ভরিয়েও দেন।

আর দেবদাস কাহিনীর পার্বতী ও দেবদাসের প্রেমের করুণ আখ্যান সমাজ ও পরিবারের বিত্ত-বৈভবের অসম বিন্যাস। ভালবাসার অপার মহিমায় প্রেমের যে অন্তর্নিহিত ভাবোচ্ছ্বাস তাকে পরিশীলিতভাবে হৃদয়ের গভীরে লালন করার ইতিবৃত্ত তো চির পুরনো ও চির নতুন। প্রেম প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের নিভৃতে লালন করা এক স্থায়ী দ্যোতনা। যার জন্য মানুষ সবকিছু বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ, বিত্ত-বৈভবকে নিঃশর্তে পেছনে ফেলে নিজের গন্তব্যে চলে যায়। এমনকি প্রাণ সংহারের মতো দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। অপরাজেয় মননশিল্পী শরৎ চন্দ্র দেবদাস-পার্বতীর প্রেমকে সংসার জীবন থেকে আলাদা করে এক অনন্য পথযাত্রায় নিয়ে গেছেন যেখানে জাগতিক আশা-আকা*ক্ষাকে তোয়াক্কা না করা এক অভাবনীয় প্রেমসম্ভার যা কিনা নায়ক-নায়িকার নিভৃত অন্তর সমুদ্রের এক নিরন্তর স্রোতধারা। যা শুধু নিজের, একান্ত আপনার ও নিভৃতের এক অনুপম সাধনা। এমন প্রেমও তো এখনও হৃদয়ের নিভৃতে ঝড় তোলে, ভালবাসার ঐশ্বর্যে অন্তরিনিঃসৃত নীরব বেদনা তাকে নিজের মতো করেই কা*িক্ষত জগতে নিয়ে যায় যেখানে পার্থিব চাহিদার কোন প্রত্যাশা থাকে না। অনন্ত আর চিরন্তন এই প্রেমের  স্রষ্টা আজও পাঠকদের হৃদয়ে যথার্থ আসনে অধিষ্ঠিত।

রবীন্দ্র সৃজন প্রতিভার সুবর্ণ সময়ে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র ও তার অসামান্য সৃষ্টিযজ্ঞ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে অন্য এক আলোয় ভরিয়ে দিলেন। যুগোত্তীর্ণ ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্রের অনবদ্য শিল্পদ্যোতনায় বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় যে অভাবনীয় দীপ্তি তেমন উজ্জ্বল কিরণেও শরৎ সাহিত্য বাংলা ও বাঙালীর মননে যে নান্দনিক আভায় উদ্ভাসিক হয়ে ওঠে তেমন নবদ্যুতিও পাঠকপ্রিয়তা পেতে সময় লাগেনি। নবজাগতির উদ্দীপ্ত বলয়ে উপন্যাসের শুভযাত্রায় বঙ্গিমী প্রভাব যে মাত্রায় বিদগ¦ মহলকে আন্দোলিত করে পরবর্তীতে রবীন্দ্রসৃষ্ট কাহিনী সম্ভারও সাড়া জাগাতে বেগপায়নি। তেমনই বলিষ্ঠ আর দীপ্ত সাংস্কৃতিক আঙিনায় শরৎ চন্দ্রের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন মাত্রার গল্পগাঁথা পাঠক সমাজকে অন্য আলোকে উদ্ভাসিত করতে যুগন্তকারী প্রভাব রাখে। সেই অনবদ্য শৈল্পিক সুষমা নিজস্ব সৃজন শক্তিতে সমাজ-সংস্কারের অভিশপ্ত বিববে দীপ্ত শিখায় যে মহিমা ছড়ায় সেটা সমকালীন প্রেক্ষাপটের এক অনন্য বাস্তব প্রতিবেদন। রক্ষণশীল সমাজ ও অধিপতিদের প্রবল দাপটের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় সেটাই এই অপরাজেয় কথাশিল্পীকে অতি সাধারণ নিগৃহীত জনসমক্ষে হাজির করে। অন্য রকম আবেদন আর আলোড়নে বাংলা সাহিত্য পায় এক ভিন্ন ধারার আস্বাদ যেখানে ধর্ম, বর্ণ আর জাতিভেদের কঠিন নিগূঢ়ে আটকে থাকা অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য হতভাগ্য মানুষদের অধিকারের মাত্রায় জোরালো প্রত্যয়। আপন মর্যাদায় নিজস্ব সৃজন ক্ষমতা আর সমাজ সচেতনতায় পথিকৃৎ অগ্রজদের পাশে দাঁড়ানোর যে ধারা শরৎ চন্দ্র তৈরি করলেন সেখানে আজও তিনি অপ্রতিরোধ্য সমাজচিন্তক। সমাজের গভীরের লালন করা অনেক দুর্ভেদ্য অভিশাপকে যেভাবে আঘাত করলেন যুগের পরিবর্তনেও সেখানে তার অবস্থান মজবুত।