যেভাবে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার শুরু করল তালেবান

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৯:৩৪

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


এই মাসের শুরুতে কাবুল বিমানবন্দরের কাছে তালেবান বাহিনীর টহল। এই গ্রুপ একসময় প্রযুক্তি থেকে দূরে ছিল কিন্তু এখন তারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ছবি-রয়টার্স

সিবিএন ডেস্ক:
এ বছরের মে মাসের শুরুর দিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো যখন আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার কাজ শুরু করে, তালেবান তখনই আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর সামরিক আক্রমণ জোরদার করতে শুরু করে।

একই সঙ্গে তারা আরো একটি কাজ শুরু করে যা সংঘাত-কবলিত আফগানিস্তানের এই গ্রুপটির ইতিহাসে এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি। সশস্ত্র অভিযানের পাশাপাশি তারা সোশাল মিডিয়াতেও তাদের পক্ষে একযোগে প্রচার প্রচারণা চালাতে শুরু করে।

সোশাল মিডিয়ার বেশ কিছু অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্ক থেকে তালেবান কাবুল সরকারের কথিত ব্যর্থতার কথা তুলে ধরতে শুরু করে। একই সঙ্গে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তালেবানের বিভিন্ন ধরনের অর্জন ও সাফল্যের কথাও তুলে ধরা হয়।
তালেবানের সাম্প্রতিক কিছু বিজয়ের কথাও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পোস্ট করা হয় সামাজিক মাধ্যমে, কখনও কখনও বিজয়ের আগেভাগেই। এজন্য তারা টুইটারে নানা ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করে যার মধ্যে রয়েছে #kabulregimecrimes, যেখানে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হয়।

আরো একটি হ্যাশট্যাগ #westandwithTaliban ব্যবহার করে আফগানিস্তানের তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এবং তালেবানের #ﻧَﺼْﺮٌ_ﻣٌِﻦَ_اللهِ_ﻭَﻓَﺘْﺢٌ_ﻗَﺮِﻳﺐٌ এই হ্যাশট্যাগের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় খুব নিকটে।

একপর্যায়ে আফগানিস্তানে এই হ্যাশট্যাগগুলো বহুল প্রচার প্রায় বা ট্রেন্ড করতে শুরু করে।

এসবের জবাবে আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ তার বাহিনী এবং জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন তারা যেন সোশাল মিডিয়ায় তালেবানের বিজয়ের এসব মিথ্যা দাবি বিশ্বাস না করেন।

একই সঙ্গে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান, সামরিক অভিযানের বিস্তারিত তথ্য যাতে তারা প্রকাশ না করেন। কারণ এর ফলে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

তালেবানের সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার থেকে ধারণা করা যায়- যে গ্রুপটি একসময় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যমের তীব্র বিরোধিতা করতো সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। শুধু তাই নয়, তাদের বার্তা ও খবরাখবর আরো বহুগুণে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তারা সোশাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

তালেবান যখন ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল, তারা ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। জব্দ করেছিল টেলিভিশন সেট, ক্যামেরা ও ভিডিও টেপ। অথবা এসব ধ্বংস করে দিয়েছিল।

কিন্তু ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ারও চার বছর পরে, ২০০৫ সালে ইসলামিক এমিরেটস অফ তালেবানের একটি ওয়েবসাইট ‘আল-এমারাহ’ চালু করা হয়। এখন সেই ওয়েবসাইটে ইংরেজি, আরবি, পাশতু, দারি এবং উর্দু- এই পাঁচটি ভাষায় তাদের খবরাখবর প্রকাশ করা হয়।

এসবের মধ্যে রয়েছে অডিও, ভিডিও এবং বিভিন্ন ধরনের লেখা। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের নেতৃত্বে ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক বিভাগ এসব পরিচালনা করে।

জাবিউল্লাহ মুজাহিদের প্রথম অ্যাকাউন্টটি টুইটার বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে তার এখনকার নতুন অ্যাকাউন্ট, যেটি ২০১৭ সাল থেকে সক্রিয়, সেখানে তার তিন লাখ ৭১ হাজারেরও বেশি অনুসারী রয়েছে।

তার পেছনে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবীদের একটি বিশেষ দল যারা অনলাইনে তালেবানের আদর্শ উদ্দেশ্য তুলে ধরে বাহিনীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে।

এই গ্রুপের প্রধান হিসেবে যার নাম শোনা যায় তিনি কারী সাঈদ খস্তি। তিনি ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তানের সোশাল মিডিয়া বিষয়ক পরিচালক।

খস্তি বিবিসিকে বলেন, এই টিমের রয়েছে আলাদা আলাদা গ্রুপ যারা টুইটারে হ্যাশট্যাগের ট্রেন্ডিং এবং হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে তালেবানের বার্তা ছড়িয়ে দিতে কাজ করে।

“আমাদের শত্রুদের কাছে টেলিভিশন, রেডিও এবং সোশাল মিডিয়াতে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু আমাদের কিছুই নাই। তার পরেও আমরা টুইটার ও ফেসবুকে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং তাদেরকে পরাজিত করেছি,” বলেন খস্তি।

তিনি বলেন, তার কাজ হচ্ছে আদর্শের কারণে যারা তালেবানে যোগ দিয়েছে তাদেরকে সোশাল মিডিয়াতে নিয়ে আসা যাতে করে তারা “আমাদের বার্তা বহুগুণে ছড়িয়ে দিতে পারে।”

আফগানিস্তানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৬ লাখের মতো। দেশটিতে খুব কম জায়গাতেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, এবং সাধারণ মানুষের কাছেও ড্যাটা খুব একটা সহজলভ্য নয়।

ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তানের মিডিয়া টিম তার সদস্যদের জন্য ড্যাটা প্যাকেজের পেছনে প্রতি মাসে খরচ করে ১,০০০ আফগানি বা সাড়ে ১১ ডলার। খস্তি বলেন, “অনলাইনে যুদ্ধ করার জন্য এই অর্থ খরচ হয়।”

তিনি বলেন, ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তানের “চারটি মাল্টিমিডিয়া স্টুডিও রয়েছে। এগুলোতে রয়েছে সব ধরনের যন্ত্রপাতি যা দিয়ে অডিও, ভিডিও এবং ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং কনটেন্ট তৈরি করা হয়।”

এসব কনটেন্টের মধ্যে রয়েছে উচ্চ মানসম্পন্ন প্রচারণাধর্মী ভিডিও। এসব ভিডিওতে তালেবানের যোদ্ধাদের বীর হিসেবে তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয় বিদেশি ও জাতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথা। ইউটিউব এবং আল-এমারাহ ওয়েবসাইটে এসব ভিডিও পাওয়া যায়।

এই গ্রুপটি তাদের ইচ্ছে মতো টুইটার এবং ইউটিউবে বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ করতে পারে কিন্তু ফেসবুকে তাদের সেই স্বাধীনতা নেই। ফেসবুক তালেবানকে চিহ্নিত করেছে “বিপজ্জনক সংগঠন” হিসেবে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যেই তালেবানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট ও পেজ বন্ধ করে দেয়।

ফেসবুক বলেছে, তাদের প্ল্যাটফর্মে তালেবানের কনটেন্ট নিষিদ্ধ হওয়া অব্যাহত থাকবে।

খস্তি বিবিসিকে বলেছেন, তালেবানের পক্ষে ফেসবুকে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখা বেশ কঠিন, এবং একারণে তারা টুইটারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর হাক্কানি নেটওয়ার্ককে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করলেও এই নেটওয়ার্কে নেতা আনাস হাক্কানির এবং গ্রুপের আরো অনেক সদস্যের টুইটারে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাদের রয়েছে হাজার হাজার অনুসারীও।

তালেবানের সোশাল মিডিয়া টিমের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তালেবানের উপনেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানির একটি মতামতধর্মী নিবন্ধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের দল টুইটার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

টুইটারে তালেবানের যত অ্যাকাউন্ট সক্রিয় রয়েছে তার বেশিরভাগই এর পরে খোলা হয়েছে।

“বেশিরভাগ আফগান ইংরেজি বোঝে না, কিন্তু কাবুল সরকারের নেতারা টুইটারে ইংরেজিতে যোগাযোগের ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন। যাদের উদ্দেশ্য করে তারা এসব করছিলেন তারা আফগান ছিলেন না, তারা ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়,” বলেন তিনি।

“তালেবান এসব মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিতে চেয়েছিল এবং একারণেই আমরা টুইটারে মনোযোগ দিতে শুরু করি।”

তিনি বলেন, টিমের সদ্যদেরকে, যাদের কারো কারো হাজার হাজার অনুসারী রয়েছে, তাদেরকে টুইটার ব্যবহারের বিষয়ে বিশেষ কিছু দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তারা যেন “প্রতিবেশী দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে কোনো ধরনের মন্তব্য না করে। কারণ এর ফলে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।”

অতীতে তালেবান তাদের নেতা ও যোদ্ধাদের পরিচিতির ব্যাপারে প্রচণ্ড গোপনীয়তা রক্ষা করতো। এই গোপনীয়তা এতোই বেশি ছিল যে কারণে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লাহ ওমরের স্পষ্ট কোনো ছবি পাওয়া যায় না।

কিন্তু আজকের দিনে আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়ার চেষ্টায় তাদের নেতারা যে শুধু মিডিয়াতে হাজির হচ্ছেন তা নয়, তারা এখন সোশাল মিডিয়াতেও ব্যাপকভাবে নিজেদের তুলে ধরছেন।

তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের ব্যাপারে আগে খুব একটা জানা না গেলেও, কাবুল সরকারের পতনের পরপরই তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন, এবং তার পরপরই তালেবানের বহু টুইটার অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল পিকচার বদলে দিয়ে সেখানে তার ছবি আপলোড করা হয়।

কিন্তু অন্যদিকে, অনেক আফগান নাগরিক যারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা, মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করতো, এবং যারা সোশাল মিডিয়াতে তালেবানের সমালোচনা করতো তারা ভয়ে তাদের অ্যাকাউন্ট আপাতত বন্ধ করে দিচ্ছে। তাদের আশঙ্কা যে, এসব তথ্য ব্যবহার করে তাদের টার্গেট করা হতে পারে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা