কে.এম.নাছির উদ্দীন

সম্পাদক নুরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল ইসলাম, রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম এবং জনপ্রতিনিধি নুরুল ইসলাম। আরো কতো বিশেষণে তাঁকে বিশেষায়িত করা যায়? সেটা তাঁর সম্পর্কে না-জানলে মোটেও নয়। অত্যুক্তি হবেনা শত সংবাদ কর্মী সৃষ্টির কারিগর বললেও। আর এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর একাগ্রতা, কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিক কর্মনিষ্ঠতার কারণে।

তাঁর সৃষ্টি কর্ম সাপ্তাহিক স্বদেশ বাণী, যা সময়ের ব্যবধানে আজ “দৈনিক কক্সবাজার”। কক্সবাজার জেলার আপামর জনসাধারণের দৈনন্দিন খবরা-খবর নিয়ে যাত্রা শুরু দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকা প্রতিদিন লাখো মানুষের সামনে উপস্থাপন করছে সমাজের বাস্তব চিত্র। শুধুমাত্র নিজেকে সাংবাদিক এবং সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তিন ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর সহকর্মী সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে প্রতিষ্ঠা করেছেন-কক্সবাজার প্রেস ক্লাব।

আমার শারীরিক বয়সের দেড় গুণেরও বেশী বয়সী এ মানুষটির সাথে স্ব-শরীরে পরিচয় ১৯৯৩ সালের দিকে। আমি তৎকালীন সাপ্তাহিক চকোরীতে কর্মরত- সে সূত্রে আমার দৌঁড়ঝাঁপ সর্বত্র। দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন চকরিয়া উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা দায়ের করেন জনৈক ব্যক্তি। বিচার বিভাগ তখন প্রশাসনের অধীনে। দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে হবে- নুরুল ইসলাম সাহেব বাম হাতে একটি ডায়েরী এবং প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ পত্র হাতে নিয়ে সবেমাত্র রিক্সা থেকে নেমে আদালত অঙ্গনে ঢুকলেন। হঠাৎ তাঁকে দেখা মাত্র আমি তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। সহাস্যে তিনি আমার সালাম গ্রহণ করে করমর্দণের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে করমর্দণ করলাম।

তখন দেশে কোন মোবাইল ফোনের প্রচলন নেই এবং চকরিয়ার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল “হ্যান্ডেল মার্কা”। আজকালের মতো আধুনিক টেলিযোগাযোগের ব্যাবস্থা থাকলে হয়তো সেদিন আদালত অঙ্গনে তাঁকে বরণের জন্য অনেক সংবাদ কর্মীর সমাগম হতো। আদালতে তাঁর আগমনের কারণ জানতে চাওয়া মাত্রই তিনি খোলামেলাভাবে আমাকে জানালেন “এক ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা করেছেন” এ বিষয়ে তিনি এখানে এসেছেন। একথা বলেই তিনি সোজা উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের খাঁস কামরায় ঢুকে পড়লেন। তৎকালীন উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব মিজানুর রহমান সাহেবের সাথে আমার পুর্ব পরিচয় থাকার সুবাদে আমিও জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবের পেছনে পেছনে ঢুকে পড়লাম। তৎকালীন উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব মিজানুর রহমান সাহেব একটু “গুরু গম্ভীর” প্রকৃতির লোক ছিলেন। এমনিতে সমাজের হাতে-গোনা কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া জন প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তার মতো গণহারে উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এর সাথে সাক্ষাৎ সুযোগ না-থাকায় ম্যাজিষ্ট্রেট মিজান সাহেব মানুষ-জনের সাথে মেলা-মেশা এবং কথা-বার্তায় “পূর্ণ মাত্রায় রক্ষণশীলতা” অবলম্বন করতেন। ফলে আমি উপযাজক হয়ে জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবকে উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

কে.এম.নাছির উদ্দীন, সাংবাদিক।

উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবের আগমনের কারণ জানতে চাইলে-তিনি সবিনয়ে কারণটি জানান। প্রতি-উত্তরে উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সরাসরি জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবকে কিছু না-বলে, শুধু বললেন-এটিতো বিচারিক কার্যক্রমের বিষয়, এরপরেও আপনি যেহেতু এসেছেন- বিষয়টি আমি দেখবো। এরপর সালাম দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন এবং সাথে আমিও উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এর কক্ষ ত্যাগ করলাম। এরপর আর দেরী না-করে তাঁকে নিয়ে চিরিঙ্গা সদরের উদ্দেশ্যে রিক্সায় ওঠলাম এবং নানা কথা-বার্তার এক পর্যায়ে তাঁকে চকোরী পত্রিকার অফিস পরিদর্শণের জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি কোনপ্রকার আপত্তি কিংবা বা অজুহাত ব্যতীত আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ ও চকোরী অফিস পরিদর্শণ করলেন।

তাঁকে নিয়ে আমি যখন চকোরী পত্রিকা অফিসে ঢুকি, সবেমাত্র চকরিয়া কলেজে পাঠদান শেষ করে অফিসে এসে চেয়ারে বসা আমাদের শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অধ্যাপক এ.কে.এম. গিয়াস উদ্দীন চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবকে বরণ করলেন। জনাব নুরুল ইসলাম সাহেব পত্রিকার হাল-অবস্থা জানতে চাইলেন এবং পত্রিকাকে পাঠক সমৃদ্ধ করতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শগুলো আমাদের সম্পাদক সাহেব মনোযোগ সহকারে শুনলেন। অনেক জোরাজুরি করার পরেও জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবকে কোন ধরণের আপ্যায়ণ করা গেলনা।

স্মরণ করা যেতে পারে জনাব্ নুরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলার আরেক বরেণ্য কৃতি সন্তান, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন উপ-কমিটির সদস্য এবং কক্সবাজার প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব এডভোকেট জহিরুল ইসলাম সাহেবের বড় ভাই। সে সূত্রেও তাঁর প্রতি আমার মানসিক দূর্বলতা ছিল প্রবল। শুধুমাত্র একবারের পরিচয়ে আমার সাথে রিক্সায় চড়া এবং পত্রিকা অফিস পরিদর্শণে আসা-এটি একটি একজন মানুষের চমৎকার গুণ। এ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষটি এখন পরপারের বাসিন্দা। বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলার অ-বিভক্ত মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন কালেও তিনি যথেষ্ট সুনাম-সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।। আর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে দেশমাতৃকার প্রতি যে-অবদান, তা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের সার্বিক মূল্যায়ণে যে-জিনিসটি আয়নার মতো পরিস্কার, তা’হল তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ ব্যক্তিত্ব।

তিনি পরিণত বয়সে চলে গেলেন ঠিকই- কিন্তু তাঁর শূণ্যস্থান পূরণে কতো সময় লাগবে, তা একমাত্র সৃষ্টিই কর্তাই ভালো জানেন। তাঁর পরকাল সুখের হোক-শান্তির হোক, এটিই এ মুহুর্তে স্র ষ্টার দরবারে একান্ত প্রার্থনা।