বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার :
দেশের সবচেয়ে বড় রানওয়েটি হতে যাচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের, আর এই রানওয়ের একটি অংশ থাকবে বঙ্গোপসাগরের ভেতরে। ১০ হাজার ৭০০ ফুট দীর্ঘ এই রানওয়ের ১৩০০ ফুটই থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। বর্তমানে সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়েটি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। এটির দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। কক্সবাজারের রানওয়ে এর চেয়েও ২০০ ফুট দীর্ঘ। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়েতে যখন উড়োজাহাজ অবতরণ করবে বা উড্ডয়ন করবে তখন উড়োজাহাজের দুপাশে থাকবে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর কক্সবাজারকে বাংলাদেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দরের ৯ হাজার ফুট রানওয়ে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সেই সঙ্গে আরো এক হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে সম্প্রসারণ হবে। আর এই ১৭০০ ফিট হবে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলের ওপরে। যেখানে থাকবে সেন্ট্রাল লাইন লাইট। এছাড়াও সমুদ্র বুকের ৯০০ মিটার পর্যন্ত হবে প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইটিং।

সাগরের জলরাশি, দ্বীপাঞ্চলের সবুজ বনে ঘেরা এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত বিমানবন্দর হবে এশিয়ায় দ্বিতীয়টি। এর আগে মালদ্বীপের বিমানবন্দরটি এরকম সুন্দর পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে দেশের দীর্ঘতম রানওয়েসমৃদ্ধ বিমানবন্দর। ইতিমধ্যে রানওয়ের ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। যে রানওয়ের প্রস্থ ছিল ১০০ ফুট, এখন সেটা করা হয়েছে ২০০ ফুট। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে বিমানবন্দরটির রানওয়ে বাড়ানো হবে আরো এক হাজার ৭০০ ফুট।

রোববার (২৯ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে এই প্রকল্প কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ওপর ব্লক তৈরি করে নির্মিতব্য কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কার্যাদেশ পেয়েছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি)। দেশে প্রথমবারের মতো সমুদ্রবক্ষে নির্মিতব্য এই বিমানবন্দর নির্মাণে মোট খরচ হিসেব করা হয়েছে এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা।

মহেশখালী চ্যানেলের দিকে ভূমি অধিগ্রহণ করে মাধ্যমে রানওয়ে সম্প্রসারিত করা হবে। সম্প্রসারিত অংশ সমুদ্রের যেটুকু জুড়ে হবে সেখানে পানিতে ব্লক, জিওটিউব ইত্যাদি ব্যবহার করে শুরুতেই একটি বাঁধের মত তৈরি করা হবে। পরে বাঁধের ভেতরকার পানি সেচ করে ফেলা হবে এবং গভীর সমুদ্র থেকে ড্রেজিং করে ভেতরে এনে ফেলা হবে বালি। বালি দিয়ে ভরাটের মাধ্যমে সমুদ্রের ওই অংশটি ভরাট হলে সেখানে ‘স্যান্ড পাইলিং’-এর মাধ্যমে রানওয়ের ভিত তৈরি করা হবে। সবশেষে পাথরের স্তর বসিয়ে পুরো রানওয়ে সিল করে দেওয়া হবে। তার ওপর হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ। এরপর হবে রানওয়ের শোভাবর্ধন ও নির্দেশক বাতি স্থাপনের বাকি কাজ। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো এই প্রক্রিয়ায় কোনো বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরি হচ্ছে।

বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো. মাসুদুল হাসান বলেন, গত ১১ আগস্ট রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৯ হাজার ফুট রানওয়ের সঙ্গে যোগ হবে আরও ১৭০০ ফুট। ইতিমধ্যে আড়াই পারসেন্ট কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘সিওয়াইডাব্লিউইবি’ এবং ‘সিসিইসিসি’। প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে ৩৩ মাস।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করে রানওয়ে খুলে দেওয়া হবে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের বুক চিরে মহেশখালী চ্যানেলের কিয়দংশ ভরাটের মাধ্যমে যখন কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে, তখন দেখা যাবে সৌন্দর্যের আরেক ভিন্ন জগত।’

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আল-মামুন ফারুক জানান, ২০১৭ সালে সম্প্রসারিত রানওয়েতে বোয়িং-৭৩৭ বিমানে করে এসে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময়ই এই বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফিট থেকে ১২ হাজার ফিটে উন্নীতকরণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আনম হেলাল উদ্দিন জানান, শের বৃহত্তর বিমান রানওয়ে কক্সবাজারে করায় আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তবে প্রতিদিন বিমান ওঠানামার শব্দ দূষণে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের সমস্যা হতে পারে। এটি জনবহুল এলাকায় না করে শহরের বাইরে করলে শহর যেমন বিস্তৃত হতো, তেমনি গ্রামও শহরে পরিণত হতো।

তিনি বলেন, বিমানবন্দরের পাশে ঝাউবন দখল করে বিমানঘাঁটি করায় স্থানীয় সচেতনমহল অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

তবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে পর্যটকদের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি কমে আসবে যাতায়াত খরচও। বিশেষ করে এর মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের কক্সবাজারের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এবং রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে কক্সবাজার এখন বিশ্বব্যাপি পরিচিত। এ সময়ে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুবই জরুরি। একইসঙ্গে কক্সবাজারে ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন হলে এখানে আসবে ব্যবসায়ীরাও।