নুর মোহাম্মদ

গত কয়েকদিন আগে চিন পরিচিত এক নেটিজেন আসলো। সম্পর্কে আমার ভাইগ্না হয়। আমাকে দেখে বলল, মামা আপনার মোবাইলটা কোথায়? একটু দেন তো কাজ আছে।
আমি বললাম, কি হইলো ভাইগ্না কোন গরম খবর-টবর আছে নাকি?
ভাগ্নে বলল, এত কথা জিগাও কেন মামা? মোবাইল দিতে বলছি দাও।

দিলাম মোবাইল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমার জন্য হ্নীলার অমৃতসম দশ টাকা দামের খাঁটি গরুর দুধের এককাপ চা অর্ডার করল। দেখতেছি মোবাইলটা হাতে নিয়ে কি সব হাবিজাবি টিপতেছে। চা এসে হাজির।আমিও আচ্ছাছে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম। আষাঢ়ের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের সাথে শরীরটা চাঙ্গা হইতেছিল।
আমি মনে করছিলাম, ভাইগ্না গত রাতের কোন খেলাধুলার খবরা-খবর দেখতেছে।

না। কি সব আগড়-বাগড় করে মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,আপনাকে একটা টিকটক অ্যাপ ডাউনলোড করে দিলাম আর একাউন্টও করে দিলাম। আপনি এখন ইচ্ছা মত টিক টক ভিডিও দেখতে পারবেন। আপনাকে একাউন্টটা করে দিয়ে আমার টার্গেট পূরণ হয়ছে। আমি এখন বত্রিশো টাকা পাব। আমি হা করা মুখটা নামিয়ে বললাম, কি কস, মামুর বেটা?

হ মামু,ভাইগ্না বলল। ছয়টা একাউন্ট আমার টার্গেট ছিল আপনারটা ছিল আমার টার্গেটের শেষ একাউন্ট।আমি বললাম, ছয়টা একাউন্ট করে যদি বত্রিশো টাকা পাস (তইলে আর কা মোরাত যা পইত্য ) কোন কাজকাম করার দরকার কী? টিকটকের একাউন্ট করে দিয়ে তুই’ত রাতারাতি মালদার লোক হয়ে যাবি? আমাকে দশ টাকা দামের একটা পাইনস্যে চা ধরাইয়া দিয়া তুই কাজটা কী ঠিক করলি? টেনশন নিয়ো না মামা বলে ভাইগ্না হাসতে হাসতে চায়ের দাম দশ টাকা দিলো। সাথে আর একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বলল, মামারে একটা পানু দিও। আর মামা ঐ একাউন্টে গিয়ে টিকটক দেখিও বলে ভাইগ্না চলে গেল। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

টিকটিকির নাম শুনেছি। দেখেছি, দেয়ালের আড়ালে ফাঁকফোকারে থেকে হেঁটে হেঁটে পোকা মাকড় খায়। আমি আবার টিকটিকি বাতিকগ্রস্ত। আর এদিকে এটা টিকটক না টিকটিকি! টিকটিকি না টিকটক এ দোটানার টুটি চেপে টিকটিকি ভয় তুচ্ছ করে দেখি টিকটক আবার কী জিনিস? আমি মানুষটা একটু হুজুগী!

ভাইগ্না যাওয়ার পরে মোবাইলটা হাতড়ে টিকটক ব্রাউজার এ লগিন করে চোখ তো আমার চানাবড়া, হায়! হায়! এ তো দেখি নাচা-গানার জম্পেশ একটা প্লাটফর্ম। নাচ-গানের আমি তেমন পাঁড় ভক্ত নই। মোটামোটি আর কি। তারপরেও একটার পর একটা স্ক্রলিং করে দেখতে লাগলাম। দেখি কেউ হাঁসছে, কেউ ফানি করে কাঁদছে, কেউবা হাসাইতেছে, কেউ রঙঢং করতেছে, কেউ সঙ সেজে ভঙ করতেছে। অদ্ভুত কাজ কারবার আর সাজ-সাজ্জায় একেবারেই রবরবা। দুধের শিশু থেকে আরম্ভ করে শহর, গেরামের উঠতি কিশোর, যৈবন ভরা টগবগে যুবক, বার্ধক্য বাসা বাঁধা শতবর্ষী বুইড়া-বুড়ি নানান দেশের নানান কিসিমের গানে-গানে ঠোঁট মিলায়া গাইতেছে। আর পারলে কেউ হাত-ঠ্যাং মুচড়া-মোচড়ি করে মর্জি মাফিক নাচতেছে। এসব দেখে ভুলে গেলাম হাসব না কাঁদব। ভাবতেছি আহ! পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্যের পরে অষ্টম আশ্চর্য বুঝি এই টিকটক নামক টিকটিকি। ত্রিশ সেকেন্ডের ওপর কোন ভিডিও ক্লিপসের ব্যাপ্তি দেখলাম না। দেশ-বিদেশের অদেখা অচেনা গান্ডু- আগান্ডু, তৃতীয় লিঙ্গ থেকে শুরু করে এলাকার পাঙ্কু মার্কা ছেলেমেয়েরা যতসব বস্তা পঁচা কৌতুকে কামরুপ কামাখ্যার তান্ত্রীক সিদ্ধি লাভের মত অসাধ্য সাধনে মেতে উঠেছে। যা বুঝলাম, তারা সেলিব্রিটি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া। একবার ভাইরাল হতে পারলে দেশসুদ্ধ পরিচিতি লাভ করবে। অতপর স্টার। সেটা হিরো আলম হোক বা শ্যামল কুমার নো সমস্যা! হুম।
আমার এলাকার পরিচিত দুই একজন চিংড়ি মাছের লেজ চুষে খাইতে না জানা নম্রভদ্র কইতরা- কইতরীদেরও দেখলাম টিকটক সেলিব্রিটি হওয়ার লাইনে।

ফিল্মের শুটিং এর মতো এসব শুট করার নির্দিষ্ট কোন স্থান নাই। কেউ বাড়ির ছাদে, ঘরের পিছে, কেউ ঘরের ভিতরে, কেউ পার্কের বাগানে, কেউ টয়লেটে, কেউ বিলেঝিলের খুল্লাম খুল্লা জায়গায়, কেউ আবার কুইজ্জ্যা তলায়, কেউ পাহাড়ী ঢালায় বা চরায়। আবার অনেকে বান্ধব-বান্ধবী সমেত হইয়া বইসা, খাড়াইয়া হাসির ফোয়ারা ছোটাইয়া মশকরা ইয়ার্কিতে মত্ত। বুঝলাম ওরা সবাই সেলিব্রিটি হওয়ার রোগে আক্রান্ত। এতদিন টিকটকের নাম শুনেছি আজকে দেখলাম টিকটকের যতসব ফুকফাক।

এবার একটু সেটিংসে যাই। দেখি কি আছে? বারে …. পুরাই টাশকি খাইয়া চক্ষু চড়কগাছ। আ হা… হা… মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। পানি না চাইতে শরবত!
পার্লার থেকেও বিশাল আয়োজন। আপনাদের এতগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করার আমার মুরদ নাই। আমি যা জানি ওটাই বলি, মেকআপ বক্স, লাইটিং, চোখের জলের গ্লিসারিন, নাটক মুভির স্লো মোশন, চটকানি দেওয়া নানা ভঙ্গিমার ইমোজিতে ভরপু……..র। ভার্চুয়াল কর্মযজ্ঞের বড্ড এক র’ঙ্গ পুর।
ডারউইনের তত্ত্ব মতে, মানুষের বিবর্তন নাকি বাদর থেকে আর টিকটকের এসব ফিল্টার ব্যবহার সন্দেহাতীত মানুষকে পুনরায় রিয়েল থেকে ভার্চুয়াল বাদরে পরিণত করছে। তার মানে বর্তমান প্রজন্ম এক প্রকার শেকড়ের টানে শহর থেক গ্রামে ফিরে যাওয়ার মত অবস্থা।
আর এদিকে আমি ব্যাটা মনে মনে বিড়বিড় কইরা আউড়াইতেছি যত আছে মানুষ মার্কা পাগল-ছাগল, সাপ-বান্দর, জিরাফ হাতি আস্ত চিড়িয়াখানা নয় বটে আস্ত একটা সার্কাস টিম।

এই ফাঁকফোকার গলে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, আমগো পাড়ার পাশের বাড়ির এক মালকিনও দেখি টিকটক নায়িকা। এর’চে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই বাড়িতে কাজের মেয়ে যে আছে সেও টিকটক নায়িকা। লাইক কমেন্টের হিসাবে দেখলাম, মালকিনের চেয়ে কাজের বেটির লাইক কমেন্ট বেশি।
মাথা আউলাইয়া আসতেছে। টিকটকের ফুকফাক দেখে আমিও নিঃশব্দে, নিঃসংকোচে অ্যাপটাকে দয়া-মায়া ছাড়া নিষ্ঠুরের মতো আনইন্সটল করে দিলাম।

ইতিমধ্যেই হাইকোর্ট অন্যান্য আজাইরা অ্যাপের পাশাপাশি টিকটক অ্যাপও বন্ধের আদেশ দিয়েছে।আজব ব্যাপার হচ্ছে তারপরেও ডিজুস পোলা-মাইয়াদের ফোনে টিকটক চলতেছে অহর্নিশ ঠিকঠাক।

কথায় আছে- টিকটিকির লেজ বাড়ে খসিবার তরে।
আর টিকটকের পেট বাড়ে সেলিব্রিটি হওয়ার তরে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ ,কক্সবাজার সিটি কলেজ।