মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

বুধবার ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০১৭ সালের এদিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের ঢল নেমেছিল। এদিন থেকে পরবর্তী প্রায় একমাস পর্যন্ত ৮ লক্ষ ১৯ হাজার ৭৮৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে আগমন করে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরনার্থী ক্যম্পে আশ্রয়ে থাকা এসব শরনার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের কাছে ৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩১৯ জন রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছিলো। মিয়ানমার সরকার এদের মধ্য থেকে মাত্র ১০ হাজার ৭০৪ জনকে ফেরত নেওয়ার জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু এ ছাড়পত্র পাওয়ার দীর্ঘ আড়াই বছর অতিবাহিত হলেও একজন রোহিঙ্গা শরনার্থীও মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি। পর পর ২ বার মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য দিনক্ষণ ঠিক হলেও মিয়ানমার সরকারের অনীহায় ২টি প্রত্যাবাসন উদ্যোগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। গত একবছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আর কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। কুটনৈতিক মহলেও রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক কোন লক্ষণ নেই।

বরং সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়ার বিপরীতে সকল রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে এদেশে স্থায়ী করার জন্য বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া এ প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে নাকচ করে দিয়েছে।

অথচ টেকনাফের কেরুনতলীতে একটি, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে আরো একটি সহ মোট ২টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র তিন বছর আগে থেকেই নির্মাণ করা আছে। আরআরআরসি অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, এই ২টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র ছাড়াও বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে আরো ২টি নতুন প্রত্যাবাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।আগের প্রত্যাবাসন কেন্দ্র ২টিকে করোনাকালীন রোহিঙ্গাদের জন্য কোয়ারান্টাইন সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরনার্থী আসা শুরু হওয়ার পর পার্সপোট অধিদপ্তর ও সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে অগুছালো পরিবেশে যে রেজিষ্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো-সেখানে অনেক রোহিঙ্গা শরনার্থী দ্বৈত সুবিধা নেওয়ার জন্য দ্বৈত রেজিষ্ট্রেশন করেছিলো। ফলে সে রেজিষ্ট্রেশনে রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা ছিলো-মোট ১১লক্ষ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। পরে সার্ভার যুক্ত করে রেজিষ্ট্রেশন হওয়ায় রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক কমে ৮ লক্ষ ১৯ হাজার ৭৮৭ জনে দাঁড়ায়। যেখানে পরিবারের সংখ্যা হয়েছে এক লক্ষ ৭৯ হাজার ৫৯০ টি। গত চার বছরে ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশু, পরে মায়ানমার থেকে বিভিন্নসময়ে বিচ্ছিন্নভাবে আসা রোহিঙ্গা, পুরাতন রোহিঙ্গা সহ বর্তমানে রোহিঙ্গার এ সংখ্যা সাড়ে ১০ লক্ষের উপরে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালের আগে যারা যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিলো, তাদের শরনার্থী মর্যাদা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্ট হতে আগত রোহিঙ্গাদের শরনার্থী মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তাদেরকে বলা হয়, ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মায়ানমারের নাগরিক’ অর্থাৎ Forcibly Displaced Myanmar Nationals (FDMN)।

৩৪ টি ক্যাম্পে অবস্থান করা এসব রোহিঙ্গারা তাদের আগমনের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি বলে জানা গেছে। তারা বর্ষপূর্তি উদযাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিও চাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পে কর্মরত আইএনজিও এবং এনজিও সমুহের সম্মিলিত সংগঠন আইএসসিজি এর পক্ষ থেকে ক্যাম্পে চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন না করার জন্য ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের অভ্যন্তরে উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও রেজিস্ট্রাড রোহিঙ্গা মোহাম্মদ শফি জানান, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি জনিত স্বাস্থ্যবিধি মানা, গত ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে বিশাল সমাবেশ করার ফলে প্রশাসন এ নিয়ে বিব্রত হওয়া, আবাহওয়া প্রতিকূলে থাকায়, ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক থ্রীজি’র নীচে থাকা সহ আরো বিভিন্ন কারণে এবার তারা কোন বর্ষপূর্তি উদযাপন করছেন না।

আরআরআরসি অফিসের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩০ হাজার ৪০০ জন শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে জন্ম লাভ করে। তবে আগমনের প্রথম বছর এ সংখ্যা ছিলো আরো অনেক বেশি। সে হিসাবে গত ৪ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ শিশু ক্যাম্প সমুহে জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এতিম রয়েছে, ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। এরমধ্যে ১৯ হাজার ৫৯ জন ছেলে ও ৮২ হাজার ৮৮২ জন মেয়ে। আবার এরমধ্যে, ৮ হাজার ৩৯১ জনের মাতা-পিতা কেউ নেই।

আরআরআরসি অফিসের প্রদত্ত পরিসংখ্যান মতে, বছরে গড়ে গর্ভবতী হয় হয়-৩৫ হাজার ৪ জন মহিলা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উখিয়া টেকনাফের ভূমি ব্যবহার করা হয়েছে ৬ হাজার ৫ শ’ একর। ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ২৮ টি ক্যাম্পে UNHCR এর আর্থিক সহায়তায় ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে।

ক্যাম্প গুলোতে নলকূপ বসানো হয়েছে ৮ হাজার ৯ শ’ ২৫ টি, লেট্টিন স্থাপন করা হয়েছে ৫ হাজার ৭শ’ ৩৬ টি, অস্থায়ী ও মধ্য মেয়াদী শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ১২ হাজার ৬০৭ টি, গোসলখানা নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫২২ টি, ক্যাম্প গুলোতে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ৩৪’৬০ কিঃমিঃ, ক্যাম্প এরিয়ার অভ্যন্তরে খাল খনন করা হয়েছে ৩০ কিঃমিঃ, বন্য হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জন রোহিঙ্গার। ক্যাম্প এলাকায় বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪ হাজার ৩০০ টি। এক লক্ষ ৯২ হাজার ৫৪৭ পরিবারকে জ্বালানি হিসাবে এলপিজি সরবরাহ করা হয়েছে।

এদিকে, ৩৪ টি ক্যাম্পে গত ১৬ মাসে গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছে মোট ২ হাজার ৯০১ জন রোহিঙ্গা। তারমধ্যে উখিয়ার ক্যাম্প গুলোতে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৩৩২ জন এবং টেকনাফের ক্যাম্প গুলোতে আক্রান্ত হয়েছে ৫৬৯ জন রোহিঙ্গা। তারমধ্যে, মোট ২ হাজার ৬৮৬ জন রোহিঙ্গা সুস্থ হয়েছেন। এরমধ্যে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যূবরণ করেছে মোট ৩১ জন রোহিঙ্গা। এরমধ্যে উখিয়ায় ২৯ জন এবং টেকনাফে ২ জন।

৩৪ টি ক্যাম্পে গত ১০ আগস্ট থেকে ৫৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সীদের করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩৬ হাজার ৯৪৩ জনকে টিকা’র প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে, ২১ হাজার ৬৭৩ জন পুরুষ রোহিঙ্গা এবং ১৫ হাজার ২৭০ জন মহিলা রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গারা মাদক, নর হত্যা, অপহরণ, স্বর্ণ চোরাচালান, ডাকাতি, দখলবাজী সহ সহ বিভিন্ন অপরাধকর্মে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন ইয়াবা সহ রোহিঙ্গারা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে ইয়াবার কারবার এখন অনেকটা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মের কারণে উখিয়া-টেকনাফ সহ পুরো কক্সবাজারে আইনশৃংখলা পরিস্থতির অবনতি হয়ে থাকে।

এদিকে, গত একবছরে কয়েক দফায় প্রায় ৩৮ হাজার রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভাসানচরে আরো রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে।

রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবিতে বুধবার ২৫ আগস্ট সকাল ১০ টায় কক্সবাজার পৌর কার্যালয়ের সামনে এক অবস্থান কর্মসূচীর আয়োজন করেছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি। কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার জন্য কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হোসাইনুল ইসলাম বাহদুর ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক ইমাম খাইর সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।