সোয়েব সাঈদ, রামু:
ডান হাতের দুটি আঙ্গুল নেই, বাম হাতও অবশ। একারণে প্রতিবন্ধি ভাতা পান কৃষক নজির আলম। ২ ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে ইসমাইলও প্রতিবন্ধি। সেও পায় সরকারের প্রতিবন্ধি ভাতা। দুই জন প্রতিবন্ধি সদস্য থাকা এ সংসারের আয়ের একমাত্র উৎস বনজায়গীরদার সূত্রে পাওয়া বন বিভাগের জমিতে ৮ বছর আগে সৃজন করা লেবু বাগান। প্রতিটি গাছে লেবুও ধরেছিলো ২০০ থেকে ৫০০ টি পর্যন্ত। লোলুপ বন কর্মকর্তাদের খায়েস পূরণ করতে না পারায় গত ২৯ জুলাই কেটে দেয়া হয়েছে প্রতিবন্ধি নজির আলমের কষ্টে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাগানের ফলবান ৫ হাজার গাছ। কেটে দেয়া এসব গাছে ছিলো ১০ লাখের বেশী লেবু।
বন বিভাগের কথিত হর্তা-কর্তারা এতে ক্ষান্ত হননি। তারা লেবু গাছ কেটে দেয়ার পর থেকে গত ২৩ দিনে প্রতিবন্ধি নজির আলম (৪৪) ও তার বড় ছেলে আরিফুল হক (১৭) কে অভিযুক্ত করে রামু থানা ও আদালতে দায়ের করেছেন ৫টি মামলা। নজির আলম কক্সবাজারের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের বাসিন্দা।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) তৌহিদুল ইসলাম ও জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ টিটু পরিকল্পিতভাবে বিশাল এ লেবু বাগানটি নিধনের পর উল্টো কৃষকের বিরুদ্ধে এসব হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে বন কর্মকর্তা ও রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিবন্ধি কৃষকের লেবু বাগান নিধনের পর এবার তার ও ছেলের নামে ৫টি মামলা দায়েরের এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী। ক্ষুব্দ জনতা অবিলম্বে দোষী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও রেঞ্জ কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি এবং লেবু বাগান কেটে দেয়ার ঘটনায় প্রতিবন্ধি কৃষক পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এঘটনার পর এলাকা জুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার হলে গত ৫দিন ধরে এলাকা ছেড়েছেন জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ টিটু। এ ব্যাপারে জানার জন্য সোমবার (২৩ আগষ্ট) সন্ধ্যায় তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে- সংসার চালানোর একমাত্র মাধ্যম লেবু বাগানটি হারিয়ে আহাজারিতে বুক ভাসাচ্ছেন কৃষক নজির আলম (৪৩), অপরদিকে বন বিভাগের ৫ টি মামলা মাথায় নিয়ে এখন ভয়ে পথে পথে ঘুরছেন। একজন প্রতিবন্ধি কৃষক পরিবারের লেবু বাগান কেটে তার বিরুদ্ধে উল্টো ৫ টি মামলা দায়ের ঘটনায় নৈপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও)।
এ ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশ বন বিভাগের চট্টগ্রামস্থ বনসংরক্ষক (কনজারভেটর অব ফরেষ্ট-সিএফ) আবদুর আউয়াল সরকারের সাথে রবিবার যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান- ‘কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের জোয়ারিয়ানালা এলাকার প্রতিবন্ধি কৃষকের লেবু বাগান কেটে দেওয়ার বিষয়টি আমি দেখছি। এ ঘটনায় দোষী কর্মকর্তা-বনকর্মীদের বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নেব’।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতিবন্ধি কৃষক বনবিভাগের জোয়ারিয়ানালা বনবিটের জুমছড়ি বনাঞ্চলের ৪০ হেক্টর সেগুন বাগানের মূল্যবান সেগুন গাছ কাটার ব্যাপারে বরাবরই প্রতিবাদ মূখর ছিলেন। সেগুন বাগানটির পাহারাদার হিসাবে নজির আলম বাগানটির সরকারি সম্পদ রক্ষায় ছিলেন অনড়। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তা স্থানীয় হেডম্যান বশির আহমদের যোগসাজসে ২০০০ হাজার সালের সেগুনবাগানটি ‘রক্ষক হিসাবে ভক্ষকের’ ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে উঠেপড়ে লেগে যান। এ কারনে প্রতিবন্ধি কৃষক নজিরকে পথের কাঁটা সরাতে তার পাওনা টাকা না দিয়েই পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে একে একে তার লেবু বাগানটি কেটে ফেলা হয় এবং সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে ৫ টি সিরিজ মামলা দিয়ে একেবারে ঘরছাড়া করে দেওয়া হয় তাকে। এসব ঘটনায় বন বিভাগের নিয়োজিত হেডম্যান (বন জায়গীরদার) বশির আহমদ ও আলী আহমদ সর্বতোভাবে বন কর্মীদের সহযোগিতা দিয়ে আসছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবন্ধি নজির আলমকে পাহারাদারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে দিনরাত জুমছড়ির সেগান বাগানটি সাবাড় করা হচ্ছে। বশির আহমদহেডম্যানের নেতৃত্বে বাগানটির কোটি কোটি টাকার সেগুন গাছ কেটে ফেলাহচ্ছে। গত ২৯ জুলাই নজির আলমের লেবু বাগানটি কেটে ফেলার পর থেকে সংরক্ষিত বনবাগানের সেগুন গাছ কাটার ঘটনা ঘটছে অহরহ। গত শুক্রবার একদিনেই ৩০/৪০ টিসেগুন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বনকর্মীরা বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন কথা। জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ কর্মকর্তাসুলতান মাহমুদ টিটু গতকাল কালের কন্ঠকে বলেন-‘ গাছ থাকলেই কাটা যাবে, এটাসত্যি। শুক্রবার ৭ টি কাটা সেগুন গাছ উদ্ধার করা হয়েছে।’ অপরদিকে বন বিট কর্মকর্তা এলমুন বাহার বলেছেন, তিনি সরেজমিন সেগুন বাগানে গিয়ে কাটাগাছের মুথা দেখেছেন এবং ৪ টি কাটা সেগুন গাছ অফিসে নিয়ে এসেছেন। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) তৌহিদুল ইসলাম পরিত্যক্ত বনভুমিতে গড়ে তোলা লেবু বাগানটি ইতিপূর্বে কেটে ফেলার কথা স্বীকার করলেও কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ব্যাপারে কোন টু শব্দটিও করেন নি। এসব মামলার মধ্যে বিভাগীয় কর্মকর্তা নিজেই বন আইনের ৪টি মামলা কক্সবাজারের জেষ্ঠবিচারিক হাকিম (আমলী আদালত নং-১) আদালতে রুজু করেছেন। অপরদিকে রামু থানায় গত ৫ আগষ্ট রেকর্ড করা হয়েছে অপর একটি। পাহাড়ে অনধিকারপ্রবেশ করে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি ও বন কর্মীদের হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ এনে জোয়ারিয়ানালা বনবিট কর্মকর্তা এলমুন বাহার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। সবগুলো মামলার আসামী প্রতিবন্ধি কৃষক নজির আলম ও তার পুত্র আরিফুল হক।
রবিবার ডিএফও’র কাছে জানতে চাওয়া হয় গত ২৯ জুলাই একজন প্রতিবন্ধি কৃষকের লেবু বাগানটি কেটে ফেলার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কেন ৫টি মামলা রুজু করা হল ? মামলার কথা বললে ডিএফও চুপ থাকেন। তবে ওই কৃষককে তার (ডিএফও) কাছে পাঠিয়ে দিতে বার বার অনুরোধ করেন। তবে মামলার কারনে কৃষক ও তার পুত্র ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানোর কথা জানানো হলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে পড়েন।
এলাকায় আরো অনেক লেবু বাগান থাকলেও এ যাবত অন্য কোন লেবু বাগান উচ্ছেদ করা হয়নি। কেবল প্রতিবন্ধি কৃষক পরিবারের লেবু বাগানটি কেটে ফেলার নেপথ্যে বন কর্মীদের ব্যাপক দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে এমন কাজটি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স জানিয়েছেন- ‘এমন অমানবিক ঘটনা আমাদের এলাকায় কখনো হয়নি। কৃষক নজির আলম নিজে প্রতিবন্ধি এবং তার দুই ছেলের মধ্যেও একজন প্রতিবন্ধি। ৫ হাজার লেবু গাছের বাগানটি কেটে তাকে একদিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে তার মাথার উপর তুলে দেওয়া হয়েছে ৫ টি মামলাও।’
কেটে ফেলা লেবু বাগানের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক নজির আলম জানান- ‘বন বিভাগের বাগান পাহারাদারের একটি টাকাও না দিয়ে উল্টো আমাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুন বাগান কাটতে না দেওয়াই আমার অপরাধ। এজন্য আমার লেবু বাগানটি কেটে দেওয়া হয়েছে। এরপর মামলাও দেওয়া হয়েছে ৫ টি।’ তিনি আরো জানান, তার বাম হাত অবশ এবং দুইটি আঙ্গুল না থাকায় তিনি সরকারি প্রতিবন্ধি ভাতা পেয়ে থাকেন। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেও প্রতিবন্ধি ভাতা পায়। তার চিন্তা কেবল ৫ টি মামলা। তার উপর একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান আরিফুল হক কেও মামলার আসামী করায় পিতা-পুত্র এখন ঘরছাড়া। ঘরের ৭ জন পোষ্য খেয়ে না খেয়ে এখন দিনাতিপাত করছেন-জানান প্রতিবন্ধিকৃষক নজির।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের জোয়ারিয়ানালা বন রেঞ্জের প্রায় ২০ কানি (৮ একর) পরিত্যক্ত বনভুমি জুড়ে একটি লেবু বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন নজির আলম। স্থানীয় সোনাইছড়ি খালের তীরে ভিলেজারের (বনজায়গীরদার) উত্তরাধিকার সুত্রে বনকর্মীদের অনুমতি সাপেক্ষে বনভুমিতে লেবু বাগানটি করা হয়। এর আগে ওই বনভুমিতে গত ২০ বছর ধরে তিনি তরমজু, মরিচ সহ বিভিন্ন সবজি চাষ করে আসছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেখানে অপহরণকারি ও ডাকাতদলের উৎপাত বাড়লে তিনি ৮ বছর পূর্বে সেখানে লেবু চাষ শুরু করেন।