এ কে এম ইকবাল ফারুক,চকরিয়া:

কক্সবাজারের চকরিয়ায় জমির বিরোধ নিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন নোবেলের (৪২) পরিবারে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের অভিভাবক বড় ছেলেকে হারিয়ে তার মা, স্ত্রী, দুই শিশুপুত্র, ভাই বোন ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। পুত্র শোকে কাতর হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন নাসির উদ্দিনের মা রোফেয়া খানম। পিতাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে নাসির উদ্দিন নোবেলের দুই শিশু পুত্র নাবিল (৯) ও নিহাল (৬)। স্বামীর মরদেহের ময়না তদন্তের জন্য মা কক্সবাজার থাকায় দাদীর পিছূ ছাড়ছিলোনা নোবেলের দুই শিশুপুত্র। দাদীর কাছে অবুঝ দুই শিশু বার-বার জিজ্ঞেস করছিলো তাদের বাবা কোথায় ? তারা তাদের বাবাকে এনে দেয়ার জন্য দাদীর কাছে বায়না ধরছে। আর এসব দৃশ্য দেখে নোবেলের বাড়িতে উপস্থিত সবাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। বুধবার (১৮ আগস্ট) দুপুর ১টার দিকে উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার পাড়ায় নিহত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন নোবেলের বাড়িতে গিয়ে এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখা গেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বুধবার দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার থেকে নোবেলের মরদেহ আনার আগে তার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, এলাকার লোকজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের ভীড় জমে যায়। নাসির উদ্দিন নোবেলকে এক পলক দেখার জন্য তার বাড়িতে হাজার-হাজার লোকের সমাগম ঘটে। এ সময় বাড়ি ও আশপাশ এলাকায় তিল ধরনের ঠাঁই ছিলনা। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে নোবেলের মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে তার নিজ বাড়ি উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের সিকদাপাড়া এলাকায় নিয়ে আসলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

এদিন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে স্থাণীয় পূর্ব বড় ভেওলা জয়নাল আবেদীন মহিউচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্র্রাসা মাঠে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন নোবেলের জানাযা অনুষ্টিত হয়। জানাযায় কক্সবাজার-১(চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাংসদ জাফর আলম,চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধূরী, ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি এম আর আজিম, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টোসহ দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও এলাকার সর্বস্থরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। জানাযার নামাজের পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সাংসদ জাফর আলম বলেন, আমি আজকে জানাযা মাঠে আপনাদের ওয়াদা দিয়ে গেলাম ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন নোবেল হত্যাকন্ডের সাথে যারাই জড়িত, তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। নিরাপরাধ কোন ব্যক্তি যাতে হয়রানী না হয় সে বিষয়ে তিনি সজাগ দৃষ্ঠি রাখবেন বলেও জানান। পরে জানাযা শেষে নাসির উদ্দিন নোবেলকে স্থাণীয় সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

প্রসঙ্গত: গত মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) দুপুরে চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের মুবিনপাড়া এলাকায় জমির বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন নোবেল। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় আরো ৯ জন। নিহত নাসির উদ্দিন নোবেল পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের সিকাদার পাড়া এলাকার আবদুল খালেক সিকদারের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরের এমইএস কলের ছাত্র সংসদের সাবেক সমাজকল্যান বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার বাসিন্দা ও স্থাণীয় সমাজ সর্দার মো. বদর মিয়া বলেন, মূলত: জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এ হত্যাকান্ডটি সংগঠিত হয়েছে। আমার জানামতে বিরোধীয় জমির মালিক নাসির উদ্দিন নোবেলের দাদা। তারা এসব জমি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখলে রয়েছেন। কিন্তু ওই জমির কিছু অংশ একই ইউনিয়নের হাজী রওশন আলী সিকদার পাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন মেম্বারদের নামে দিয়ারা রেকর্ড চুডান্ত হয়। তারই সূত্র ধরে ওই জমির মালিকানা দাবী করে আসছিলেন আমির হোসেন মেম্বার গং।

তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার সকালে ওই জমিতে নাসির উদ্দিনের বর্গাচাষী আকতার আহামদ চাষ করতে গেলে তাকে মারধর করে জমি থেকে তুলে দেন আমির হোসেন মেম্বারের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী এনাম, শামীম, রুবেল, হেলাল, রমিজ ও শহীদ। পরে এ বিষয় নিয়ে এনামের সাথে মোবাইলে কথা বলে ১০-১২জন লোক নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় নাসির উদ্দিন নোবেল। এ সময় এনামের নেতৃত্বে নাসির উদ্দিন ও তার সাথে থাকা লোকজনের তাদের উপর উপুর্যপরী গুলি ছোঁড়ে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নাসির উদ্দিন নোবেল। আহত হয় তার সাথে থাকা ১০জন। পরে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক নাসির উদ্দিন নোবেলকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যান্য আহতদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, নাসির উদ্দিন নোবেলকে প্রতিপক্ষের লোকজন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। নাসির ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরপরই সন্ত্রাসীরা ৮টি বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় নাসিরের সাথে থাকা আমার ভাই আজিজুল হক গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

নিহত নাসির উদ্দিনের চাচা আজিজুল হক আবু দাবী করেন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য গত দুই বছর ধরে এলাকায় কাজ করে আসছিলেন আমার ভাতিজা নাসির উদ্দিন নোবেল। শুধু জমি নিয়ে বিরোধ নয়, আগামী নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে গত বারের পরাজিত আওয়ামীলীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী খলিলুল্লাহ চৌধূরীর নির্দেশেই আমার ভাতিজাকে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার ভাতিজা নোবেল এলাকার লোকজনের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় পরিচ্ছন্ন নেতা ছিলেন। চেয়ারম্যান পদের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতেই খলিলুল্লাহ চৌধূরী সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে আমার ভাতিজা নোবেলকে খুন করিয়েছেন। আমি এ জঘন্য বর্বর হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা ও ঘটনার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার পূর্বক আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের বলেন, নাসির উদ্দিন নোবেল হত্যাকান্ডের ঘটনায় এখনো থানায় এজাহার দেয়া হয়নি। মরদেহ দাফনের কাজে ব্যস্থ থাকায় হয়তো এজাহার দিতে দেরি হতে পারে। তবে তা জমা দিলে মামলা হিসেবে নেয়া হবে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে রয়েছে বলেও জানান তিনি।