এম.এ আজিজ রাসেল :
অবশেষে চট্টগ্রামে সেই দিদার, দুলাভাইসহ ইয়াবা নিয়ে চট্টগ্রামে আটক হয়েছে। দিদারের নামে বেশ কয়েকবার কক্সবাজারের স্থানীয় পত্রিকায় বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সংবাদ প্রকাশের পর সে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে। সাধু সাজতে দেওয়া হয় প্রতিবাদলিপিও। তবে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। উন্মোচন হলো তার আসল চেহারা।

খুরুসকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পরিচিত মো. জয়নাল আবেদীন (৪২)। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া থানার জুলহারপাড়া গ্রামের মো. সিদ্দিক আহমেদের ছেলে জয়নাল। কিন্তু সেই শিক্ষকতার আড়ালে ইয়াবা সাম্রাজ্যে পরিচিত তিনি দুলাভাই নামে। চট্টগ্রামের ইয়াবা গডফাদারদের অন্যতম এই জয়নাল। কেউ কখনো চেহারা না দেখলেও একটি মোবাইল নাম্বারই ছিল তার পরিচয়।

মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) গভীর রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার দেওয়ানহাট মোড় থেকে তাকে দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।

গ্রেফরকৃতরা বাকি দুই জন হলেন, জয়নালের শ্যালক মো. মোবারক হোসেন (২৭) ও মো. রেজাউল করিম দিদার (৩১)। তবে দিদারের আসল নাম দিদারুল ইসলাম দিদার। সে কোথাও আটক হলে নাম ভুল দেয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল আবেদীন পুলিশকে জানান, তিনি মূলত কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে নিজের কাছে মজুদ করেন। এরপর তা সারাদেশে বিক্রি করেন।

ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘জয়নাল আবেদীন ইয়াবার গডফাদার। তাকে সবাই চেনে দুলাভাই নামে। চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার অন্যতম প্রধান যোগানদাতা তিনি। তার নাম কেউ জানেনা, কেউ কখনও দেখেওনি তাকে। শুধুমাত্র একটি মোবাইল নাম্বারই ছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার পরিচয়। সেই নাম্বারে ফোন করলেই তিনি ইয়াবা নিয়ে হাজির হতেন। ইয়াবা দিয়ে সেই নাম্বার আবারও পাল্টে ফেলতেন। দুইদিন আগে প্রায় ২২ হাজার পিস ইয়াবাসহ চালক—হেলপারকে গ্রেপ্তারের পর উঠে আসে এই দুলাভাইয়ের নাম।’

তিনি বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল রাতে দেওয়ানহাট মোড়ে ১ হাজার ৭০০ পিস ইয়াবাসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বায়েজিদ বোস্তামি থানার হাজীরপুল এলাকায় তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে তার বাসার আলনার নীচে লুকিয়ে রাখা একটি শপিং ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ২০ হাজার ইয়াবা। গ্রেফতার করা হয় তার দুই সহযোগী মো. মোবারক হোসেন ও মো. রেজাউল করিম দিদারকে। ইয়াবার গডফাদার হলেও তার ইয়াবা কারবারের ঘটনা এলাকাবাসী জানেনা। এলাকায় তিনি স্কুল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। তিনি কুরুসকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু এর আগেও একবার ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন তিনি।’

ইয়াবার আশির্বাদে টিউশন শিক্ষক থেকে কোটিপতি দিদার :

দিদারুল ইসলাম দিদার। মহেশখালী শাপলাপুর নোনাছড়ির মৃত মীর কাশেমের পুত্র। বিগত ৪—৫ বছর আগে শহরের বিভিন্ন এলাকায় টিউশনি করতেন। থাকতেন বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় তার বোনের বাড়িতে। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করায় দিদার স্যার নামে খ্যাতি পান। দীর্ঘদিন শহরে বসবাস করার সুবাদে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে মাদক ও মানবপাচার সিন্ডিকেটের সদস্যদের। কালো টাকার নেশায় ওইসময় দিদার জড়িয়ে পড়ে মানবপাচার ও ইয়াবা বাণিজ্যে। তবে মানব পাচারে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। সে। তাই ইয়াবাকে পুঁজি হিসেবে বেছে নেয় দিদার। আর অল্পদিনের মধ্যেই ইয়াবার আশির্বাদে টিউশন শিক্ষক থেকে বনে যান কোটিপতি। বর্তমানে বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় তার বোনের দুইটি বিল্ডিং রয়েছে। সে শাশুড় থেকে বিলাস বহুল দুইতলা একটি ভবন ২০ লাখ টাকায় কিনেছে। রয়েছে ৩টি ফিশিং ট্রলার। মহেশখালী এবং শহরে নামে—বেনামে কিনেছেন একাধিক জমি ও গাড়ি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবা পাচারে দিদারের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ভদ্রতার মুখোশ পড়ে এই সিন্ডিকেট দেশব্যাপী ইয়াবা পাচার করে আসছে। তার সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প এলাকার তার বোন, বাড়ির পার্শ্বে প্রাইমারী শিক্ষক জয়নাল আবেদীন, তার স্ত্রী কাউসার বেগম, মহেশখালী নোনাছড়ির বর্তমানে বাসটার্মিনালস্থ নোঙরের পেছনের রুবেল, বিজিবি ক্যাম্পের নেজাম, (চশমা নেজাম) ও শাহ নেওয়াজ। তারাই দিদারের ইয়াবা সাম্রাজ্য সামাল দেয়। এছাড়া দিদারের বাড়ির পার্শে¦ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের বাড়ি করে দেয় সে। তারা হলো— রোহিঙ্গা শুক্কুর, শাহ আলম, আবদু ছালাম, ওয়াচ কুরুনী। তাদের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান আনা হয়। বিভিন্ন জেলায় পাচারে ওইসব রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়। দিদারের নেতৃত্বে তার সিন্ডিকেট নৌপথে ইয়াবার বড় বড় চালান আনে। শহরের ফিশারীঘাটের বিভিন্ন পয়েন্টে এখানকার একজন প্রভাবশালীর মাধ্যমে ইয়াবার চালানগুলো খালাস হয়। চালান সফলভাবে খালাস হলে তা রাখা হয় তার বোন ও মাস্টার জয়নাল আবেদীনের বাড়িতে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম রাহাত্তারপুলে জয়নালের স্ত্রী কাউসারের ভাইয়ের বাড়িতে। পরে সুযোগ বুঝে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ইয়াবার চালান চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচার করে বলে সুত্র প্রকাশ। সুত্র আরও জানায়, ২০১৫ সালের জুন মাসে জোয়ারিয়ানালায় টেকপাড়ার নবাবের সিএনজি নিয়ে ইয়াবা পাচারকালে ১০ হাজার ইয়াবা নিয়ে দিদারকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ইয়াবা মামলা রুজু করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। ডিবির কাছে দিদার তার নাম পরিচয় দেয় দেলোয়ার। পরে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে আদালত থেকে সে জামিনে বের হয়ে পুনরায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া একই মাসে টেকপাড়া মানবপাচারের প্রস্তুতিকালে ৭ জন ভিকটিম উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। তাদের কে মালয়েশিয়া পাচারের লোভ দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সেখানে রাখে দিদার। অভিযান টের পেয়ে সে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। কিন্তু এর আগে সে প্রায় ১০০ জনের কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করে। তবে পাচারের শিকার যুবকরা মালয়েশিয়া পৌছেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

সর্বশেষ গত ১০ আগষ্ট চট্টগ্রামে ২২ হাজার ইয়াবা নিয়ে দিদার, জয়নালসহ  আরও একজনকে আটক হয়।