সিবিএন ডেস্ক:

“জন্মের পরপরই বাবাকে হারিয়েছি। সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলাম, স্থানীয় একজন নিয়োগকর্তার অধীনে কাজও করতাম, কিন্তু করোনা মহামারি উপার্জনের সেই পথটি কেড়ে নেয়।”- বলছিলেন চট্টগ্রামের ফারহানা। অন্যদিকে, নিজ বাড়ির বারান্দায় দাঁড় করানো ব্যবসার চরম ক্ষতিতে রাজশাহীর নূরজাদী যেনো মহামারির সংগে পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশাকে বাচিয়ে রাখতে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছেন। কেননা, স্বামীর পক্ষাঘাতের পর এটিই ছিল তাদের একমাত্র উপার্জনের দার। আমাদের চারপাশে এমন অনেক ফারহানা, নুরজাদী আছেন যাদের জীবনযুদ্ধের গল্প আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বকে নাড়া দেয়ার মতো এবং যার প্রতি আমরা প্রত্যেকে দায়ী, কিন্তু মন্দ হলেও সত্যি যে আমরা অধিকাংশ মানুষই এগুলোর প্রতি উদাসীন।

তবে ফারহানা ও নূরজাদীরা নিজেদের গল্পের উম্মোচনে ভাগ্যবতী বলে মনে করছেন নিজেদের। ফারহানাকে একটি সেলাই মেশিন ও নূরজাদীর ব্যবসার সকল খরচের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় সামাজিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান RFAC এর প্রজেক্ট জয়িতার অংশ হিসেবে। এদের মতো বিভিন্ন বয়সী ও বিভিন্ন শহরের আরো ১২ জন নারী RFAC এর এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মোতাবেক সকল ধরনের সহযোগিতা পেয়ে নিজেদের উপার্জনের পথ সচল করতে সক্ষম হয়েছেন।

পরিবর্তনের জন্য উন্নয়ন – যুবসমাজ দ্বারা পরিচালিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যা নারীদের প্রতি হওয়া অসংগতিপূর্ণ ঘটনার মতো সমাজের অন্যান্য গভীর বদ্ধমূল সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার লক্ষে প্রতিষ্ঠিত।

মূলত করোনা মহামারি প্রকোপের সময় এর যাত্রা শুরু, যখন সমগ্র দেশের মানুষ শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ছিল বিপর্যস্ত। “Listeners Team” নামে একটি বিশেষ দল আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য অনুষংগ, যা কিনা কোনো নির্যাতন বা অত্যাচারের শিকার এমন মানুষের বিশেষত কিশোর বা যুবক বয়সী যারা, তাদের ভেতরের কথা শোনে এবং তাদের সর্বউচ্চ মানসিক সহযোগিতা প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানের সেচ্ছাসেবীরা নিজে থেকেই বিভিন্নভাবে নির্যাতিত মানুষের পাশে আইনি সহযোগিতাসহ মানসিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

মহামারির আঘাতে হানিত আমাদের সল্পোন্নত অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে RFAC “প্রজেক্ট জয়িতা ” নামের একটি কর্মকান্ড শুরু করে, যা সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অর্থনৈতিক সাবলম্বনের জন্য তাদের সহযোগিতায় পৌঁছে গেছে। এরই অংশ হিসেবে গত রমজান মাসে, সেচ্ছাসেবীদের পক্ষ থেকে তোলা চাঁদার ৩০% অর্থ দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পাবনার মোট ৭৪টি পরিবারের (৫-৭ জন সদস্যবিশিষ্ট) ১২-১৫ দিনের খাবার সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। তাই বাকি ৭০% অর্থ আমাদের যাচাইকৃত ১৪ জন জয়িতা, যারা অসচ্ছলতার মধ্যে আছেন,মহামারি যাদের অসচ্ছলতাকে রীতিমতো অসহায়তে রুপান্তর করেছে, তাদের সহযোগিতায় পৌঁছে গেছে। কারো জন্য খামার গড়ে তোলা, তো কারো জন্য সেলাই মেশিনের ব্যবস্থা করে দেওয়া, আবার কারোর চোখের চিকিৎসার খরচে হাত বাড়িয়ে দেয় এই প্রজেক্ট। এমনকি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যবসার জন্যও প্রজেক্টের পক্ষ থেকে করা হয় সাহায্য। আমের রাজ্য রাজশাহী থেকে আনারস, কলার চাষক্ষেত্র রাঙ্গামাটি সবখানেই পৌছে যায় এই প্রজেক্ট। শুধু অর্থ প্রদানেই শেষ নয়, তাদের পরবর্তী যে কোনো প্রয়োজনে RFAC তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে “প্রজেক্ট জয়িতা ” আমাদের ১ম উদ্যোগ। প্রাক্তন ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল, অভিনেত্রী সাবিলা নূর, অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিনসহ আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নজর কাড়ে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। যাদের অবদান এই প্রজেক্ট সফল করে তুলেছে, তাদের সকলের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

“প্রজেক্ট জয়িতা” তে সাহায্য করা ১৪জন নারীদের গল্প নিচে তুলে ধরা হল —–

চট্টগ্রাম শহরের গা ঘেষে হাটহাজারীর বড়দিঘির পাড়। সেখানে থাকে বিবি জহরা ও তার বোন। এতিম পরিচয়টা বহু বছরের। আপন বলতে একে অন্যকেই চেনে। জীবনযাপনের জন্য সেলাইয়ের কাজটুকু শিখে নিয়েছে। কিন্তু করোনার কঠোর বাস্তবতা যেন এই জীবনযাপনে এক বাঁধা। তাই তাদের এই থেমে থাকা সময়কে আবার গতিময় করতেই প্রজেক্ট জয়িতা তাদের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেয়।

রাঙ্গামাটির রানি তঞ্ছনগ্যা। তার উপার্জনেই সংসার চলে। কিন্তু দুই ছেলের খরচ চালানো খুবই কষ্টের। তাই যেখানেই কাজ মেলে সেখানেই ছুটে যান তিনি। পেটের দায় যেন বয়সকেও হার মানায়। কিন্তু শরীরের অক্ষমতা এক বড় সত্য। চাইলেই তা উপেক্ষা করা দুষ্কর। তাই প্রজেক্ট জয়িতা চলে গেলো তার কাছে। তার একটি গরু ছিল। সাথে ছিল খামার করার কিছু জিনিসপত্র। তাই তার খামার গড়ার ও বর্ধনের দায়িত্ব নেয় এই প্রজেক্ট।

রাঙ্গামাটির আরেক জয়িতা রিনি চাকমা। তার সংসারেরও একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। স্বামী মারা গেছে আজ ৮ বছর। তাই এখন এক মেয়েকে বড় করাই তার জীবনের লক্ষ্য। রাঙ্গামাটির রাস্তার ধারেই আঞ্চলিক খাবার বিক্রি করেন তিনি। তবে তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। তাই প্রজেক্ট জয়িতা তার এই খাবার ব্যবসার হাল ধরে তার জীবন সহজ করে দেওয়ার চেষ্টায় এগিয়ে আসে।

কর্ণফুলীর তীরে এক উদ্দীপ্ত কন্যার নাম ফারহানা। জন্মের পরেই বাবা মারা যায় তার। এরপর থেকে সংসারের হাল ধরে তার ভাই। স্থানীয় এক স্কুলের পিয়ন সে। তবে সংসারের জন্য এই চাকরি যেন কিছুই না। অন্যদিকে ফারহানা যেন এক জলন্ত অগ্নির প্রতীক। তার কর্মঠ মনোভাব দিয়ে সে জয় করে নিতে চায় সকল সম্ভাবনা। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়েছে নানান প্রশিক্ষণ। শিখেছে অনেক কাজ। এমন কী এই মহামারীর মাঝেও সে থেমে থাকেনি। তার শেখা সেলাইয়ের মাধ্যমে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করে সে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি তাকে অবশেষে বন্দি করে ফেলে। আমরা চাই না, করোনার কারণে এই সুন্দর ও আলোকিত ভবিষ্যতের অবসান হোক। তাই ফারহানা ও তার পরিবারের সহজ ও উজ্জ্বল আগামীর জন্য প্রজেক্ট জয়িতা তাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেয়।

চট্টগ্রামের অক্সিজেন। ফাতেমা বেগমের স্বামী স্থানীয় এক স্কুলের পিয়ন হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু করোনার থাবা এই চাকরিও কেড়ে নেয়। তাই চারজনের এই সংসার এখন স্তব্ধ। সেলাইয়ের কাজ শিখেছে জেনে প্রজেক্ট জয়িতা পৌঁছে যায় তার কাছে। কিনে দেয়

একটি সেলাই মেশিন সহ নানান সরঞ্জাম।

পাবনার ছায়াতলে মা আর দুই মেয়ের সংসার। দারিদ্র্যতা যেন তাদের চিরসঙ্গী। প্রজেক্ট জয়িতার খাদ্যদ্রব্য প্রদানের সময় তাদের দেখা মেলে। তাদের নিরবলম্ব দিনাতিপাত সহজ করার জন্য কিছু হাস- মুরগী সহ খামার গড়ে দেওয়া হয়।

রাজশাহীর সাহসী নুরজাদি। স্বামী তার পক্ষাঘাতে নত। জীবিকার জন্য নিজের ঘরের বারান্দাতেই একটি দোকান গড়ে তোলে সে। কিন্তু সেই ব্যবসার ক্ষতিতে এখন তাদের জীবন যেন দীনতায় স্তব্ধ। তাই প্রজেক্ট জয়িতা তাদের দোকান পুনরস্থাপনের মাধ্যমে জীবন সচল করার সুযোগ করে দেয়।

নুরুন্নাহার লাকী। পাহারতলীর নয়াপাড়ায় তার বসবাস। পারিবারিক বিবাদের কারণে নিজের পিতার বাড়িতেই ভাড়া করে থাকতে হয়। স্বামীর ছোট ব্যবসা করোনায় হেলে পড়েছে। তাই নিজেই একখানা ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তাও সামান্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যার যেন কারো কাছে হাত বাড়িয়ে দেওয়াও পাপের। তার এই ছোট্ট স্থানীয় ব্যবসাটি বড় করে তুলতে তাই সাহায্য করে প্রজেক্ট জয়িতা।

সমুদ্রপাড়ের পেকুয়া অঞ্চলের বাসিন্দা তাছলিমা বেগম শারীরিকভাবে নিতান্তই দুর্বল। তার ওপর করোনা মহামারী প্রবাসী স্বামী ঘরে ফিরিয়ে এনেছে। তাই সংসার এখন পুরোপুরি অচল বললেই চলে। প্রজেক্ট জয়িতার পক্ষ থেকে তাই মাছ চাষের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য একখানা ছাগলও কিনে দেওয়া হয় তাকে।

স্বামীর স্বল্প আয়ের সংসারে তিন মেয়ে ও এক ছেলের খরচ চালানো যেন প্রতিনিয়ত এক নতুন বাঁধা। তাই প্রজেক্ট জয়িতা নাজমা বেগমকে হাস, মুরগী ও ছাগল প্রদানের মাধ্যমে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়।

তাছলিমার অঞ্চলেরই বাসিন্দা আখতারুন্নেসা। কষ্টে বড় করা সন্তানেরা আজ দূরে গিয়ে যেন তারই প্রতিদান দিচ্ছে। স্বামী অসুস্থ। এখন সন্তান বলতে ছোট ছেলেটাই পাশে আছে। তার গল্প শুনে মাছ চাষের ব্যবস্থা করে দেয় প্রজেক্ট জয়িতা। তাছাড়া হাস, মুরগী পৌঁছে দেয় তার দুয়ারপাড়ে।

স্বামী ঘর ছেড়ে নিজের জীবন গড়তে ব্যস্ত খাদিজা আখতার। পরিবার চালানোর জন্য এখন সেলাইয়ের কাজটাই ভরসা। বাচ্চাদের খরচও তার একারই বইতে হয়। তাছাড়া বাবা-মা ও বোনদের খরচ তো আছেই। তাই তার এই জীবন সহজ করতে প্রজেক্ট জয়িতা তাকে একটি সেলাই মেশিন উপহার দেয়।

অল্প বয়সেই যেন দারিদ্র্যের ছায়া আকড়ে ধরেছে জুলিকে। তার পরিবারের উপার্জনের সকল দ্বার আপাতত বন্ধ। তাই তার অভাবী সংসারের আলো হয়ে প্রজেক্ট জয়িতা তার হাতে একটা সেলাই মেশিন তুলে দেয়।

মোস্তফা খালার জীবনের সকল সম্পদ গ্রাস করে নিয়েছে রাক্ষসী সাঙ্গু। এখন জীবন ছায়া বলতে তার এক বোন মাত্র। জীবনের অপরিহার্যতা নিবারণে যেন বয়সই বড় বাঁধা। তাই অন্যের কাঁধই এখন সম্বল। এই পরনির্ভর জীবনে অস্পষ্ট দৃষ্টি যোগ করেছে নতুন এক তিমিরের সোপান। বেশ কিছুদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। তাই দোহাজারীর এই বর্ষীয়সীকে প্রজেক্ট জয়িতা এইবার তার চোখের চিকিৎসায় হাত বাড়িয়ে দেয়।

RFAC এর বিশ্বাস এই প্রজেক্ট হয়তো বড় পরিসরে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারেনি, তবুও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রজেক্টটি এমন কিছু মানুষের কাছে আর্থিক ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, যাদের প্রকৃত অর্থেই এমন সহায়তার প্রয়োজন ছিলো।