-মোহাম্মদ শাহজাহান

এক।

গত কয়েক দিনে বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুম্ব্রু প্লাবিত হয়েছে একাধিকবার। এই প্লাবনে তুম্ব্রু’র কোণারপাড়া সংলগ্ন ‘নো-ম্যান্স ল্যান্ড’-এ অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থী এক শিশু ও উত্তর ঘুমধুমের এক শিশুর সলিল সমাধিসহ তুম্ব্রুতে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মৌসুমী ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

দুই।

তুমব্রুতে এই দুর্যোগ চলাকালেই ঘুমধুম ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছৈয়দুল বশরকে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে দুর্গত লোকজনের সেবায় নেমে পড়তে দেখা গেছে। স্থানীয় জন-প্রতিনিধিরাও ছিলেন স্বক্রিয়। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন এসেছেন এগিয়ে। সর্বশেষে ৫ আগস্ট, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ঘুমধুম সফরে এসেছেন; ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের প্রাঙ্গণে আয়োজিত সভায় যোগ দিয়েছেন; করেছেন ত্রাণ বিতরণও।

তিন।

মন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে এসেছেন জেলা আইনজীবী সমিতি, বান্দরবানের বিজ্ঞ সদস্য এডভোকেট এমদাদ উল্লাহ্‌ও। তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের প্রয়োজনে তুমব্রু বাজারে যাওয়া হলো; বাজারে অবস্থিত নিজের গ্রামের চেম্বারের বেহাল দশা দেখা হলো; সর্বোপরি পাহাড়ি এই জনপদে এমনতরো প্লাবনের কারণাদি নিয়ে স্থানীয়দের মতামত জানারও সুযোগ হলো।

চার।

মর্মন্তুদ এই প্লাবনের জন্যে স্থানীয়রা মূলতঃ মিয়ানমার কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তুম্ব্রু খালে অবৈধভাবে সেঁতু-নির্মাণ করে এর নিচে স্লুইস গেট স্থাপন করাকেই দায়ী করেছেন। মিয়ানমার এই অপকর্মটি করে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। স্থানীয়দের দাবী, ওই সময় মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে বাধা দেয়া গেলে অবস্থার এতোটা অবনতি রোধ করা যেতো।

পাঁচ।

সমস্যাটির পর্যালোচনায় ইতিহাসে ভর করে একটু পেছনে যাওয়া যাক। দৈনিক ইত্তেফাক এর ১০ মে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ সংখ্যার ১ম ও শেষ পৃষ্ঠায় বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি)’র বরাতে মুদ্রিত ‘পাক-বর্মা স্থায়ী সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত’ শিরোনামের একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ হুবহু এই-‘ ইসলামাবাদ, ৯ ই মেঃ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও বর্মার বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান জেনারেল নে উইন দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী সীমানা চিহ্নিত করিয়া আজ এখানে এক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়াছেন। স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিটি কার্যকরী হয়। এই চুক্তিতে পাক-বর্মা সীমান্তে নাফ নদী এলাকার পরিবর্তনশীল সীমানাকেই স্থায়ী সীমানায় রূপান্তরিত করা হইয়াছে। ‘ এই সংবাদে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ১৯৬৬ সালেই প্রথম পাকিস্তান ও বার্মা তথা মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং সেই চুক্তিতে নাফ নদীকেই সীমানা-নির্দেশক মান্য করা হয়। আর তুম্ব্রু খাল হলো নাফ নদীরই উৎপত্তিস্থলকে সংযুক্তকারী প্রধান শাখা-নদ। তুম্ব্রু প্লাবিত হবার অনুষঙ্গটি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের এই সীমান্ত চুক্তির সঙ্গেই সরাসরি জড়িত।

ছয়।

দৈনিক ইত্তেফাকের উপরোক্ত সংবাদের সূত্রে জাতিসংঘের ডিজিটাল আর্কাইভে (digitallibrary.un.org) সংরক্ষিত সীমান্ত চুক্তিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চুক্তিটি বার্মা (মিয়ানমার) কর্তৃক ১ জুলাই, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ তারিখে জাতিসংঘে নিবন্ধিত হয়েছে। নিবন্ধন নম্বর-১৪৮৪৮। চুক্তির শিরোনাম-‘AGREEMENT BETWEEN THE GOVERNMENT OF THE UNION OF BURMA AND THE GOVERNMENT OF THE ISLAMIC REPUBLIC OF PAKISTAN ON THE DEMARCATION OF A FIXED BOUNDARY BETWEEN THE TWO COUNTRIES IN THE NAAF RIVER’ । ১০ টি মূল অনুচ্ছেদ ও ৬ টি আনুষঙ্গিক অনুচ্ছেদ সম্বলিত এই চুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এর দশ দিন আগে ২৮ এপ্রিল ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ তারিখে উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত প্রটোকল ও ৩টি মানচিত্র। এই মানচিত্রে তুম্ব্রু খাল/তুম্ব্রু এলাকা স্পষ্টরুপে চিহ্নিত রয়েছে। এই চুক্তির ১০ টি অনুচ্ছেদের মধ্যে অনুচ্ছেদ ২ ও ৫ সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। অনুচ্ছেদ ২ এর ভাষ্য- Article Two: The Contracting Parties agree that, for certainty and defnitiveness, the fluctuating international boundary in the River Section formed by the middle line of the main navigable channel of the Naaf River, as ascertained and determined by the joint Burma-Pakistan Hydrographic Survey Party, shall be deemed to be a fixed international boundary once for all with effect from the date the present agreement comes into force irrespective of any changes that may occur in the course of the main navigable channel of the Naaf River’। এই অনুচ্ছেদে দুইটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমতঃ নাফ নদীকে দুইভাগ ধরে এর ঠিক মাঝ বরাবর রেখাটিকে দুই দেশের সীমান্তরেখা মর্মে স্থির করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ নদীর পানি প্রবাহে পরিবর্তনের ফলে ওই রেখাটিও পরিবর্তিত হলে সে মোতাবেক দুই দেশের সীমানাও পরিবর্তিত হবে। মিয়ানমার প্রতিবার এই অনুচ্ছেদটিরই অপব্যবহার করে নাফ নদীতে বাঁধ নির্মাণ করার মাধ্যমে নদীর পানি-প্রবাহের গতিপথ বদলে ওই রেখাটি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়ে ফায়দা লুটার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এবার ’ অনুচ্ছেদ ৫ এর ভাষ্যটি একবার দেখে নেয়া যাক। সেটি হুবহু এই-‘Article Five: The Contracting Parties agree that, after the coming into force of the present agreement, neither party shall conduct water training works, or utilize the flow of the Naaf River or its waters on its own side of the international boundary for industrial purposes, drainange, water conservancy, irrigation, generation of hydro-electric power, and the like to such an extent as to prejudice the interests of the other party’ । মোদ্দা কথায় এর অর্থ হলো, এই চুক্তি অনুসারে চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষ নাফ নদী বা এর শাখাগুলোর পানি-প্রবাহকে এমনভাবে ব্যবহার করবে না যাতে অন্য পক্ষের স্বার্থের কোন হানি ঘটে।

সাত।

উক্তরুপ সুস্পষ্ট চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইনে এবং দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে তা প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও মিয়ানমার বারংবার চুক্তিভঙ্গ করেছে। নাফ নদীতে গায়ের জোরে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে একাধিক বার। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের তোতারদিয়ার পাশে নাফ নদীতে মিয়ানমারের বাঁধ নির্মাণের অপচেষ্টা এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমিত আকারে সংঘটিত সীমান্ত-সংঘাতের কথা তো সুবিদিত। সেই সময় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃঢ়তায় মিয়ানমারের ওই অপচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যায়। কিন্তু, ২০১৯ সালে মিয়ানমার তুম্ব্রু খালে সেতু নির্মাণ করে এর নিচে স্লুইস গেইট স্থাপনের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের তরফে কার্যকর কোন প্রতিবাদ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। বরং ওই সময় এটির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট একটি কর্তৃপক্ষের তরফে গণমাধ্যমে জানানো হয়, ‘তুমব্রু খালের ওপর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া সংস্কার করছে। খালের ওপর আগে কাঠের খুঁটি ছিল, সেটি পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেখানে আরসিসি পাকা পিলার দেয়া হচ্ছে। এটি কোনো সেতু বা বাঁধ নির্মাণ নয়।‘ (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৯)। এ বিষয়ে দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন’র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেছিলেন, বিষয়টি তাঁর নজরে এসেছে এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছে। (সূত্রঃ দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন, ১০ জানুয়ারি, ২০১৯)। প্রশ্ন হলো, তুম্ব্রু এলাকাটি বান্দরবান পার্বত্য জেলার অংশ হলেও বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে কেন এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হলো? কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ নিয়ে আদৌ অবহিত করা হয়েছিলো কিনা এবং তা করা হয়ে থাকলে উক্ত মন্ত্রণালয়ের তরফে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো?

আট।

তুমব্রু খালের এই সমস্যাটি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যাবলীতে নবতর সংযোজন। হয়তো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার যাঁতাকলে পড়ে এই সমস্যাটি তেমন পাত্তা পায়নি আমাদের শাসককূলের কাছে। এখন এটি সীমান্তে একটি বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। ফি’ বছর প্লাবিত হওয়া আর বানের পানিতে সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষের কাছে কিছু নগদ অর্থ আর শুকনো খাবারের পোটলা নিয়ে ছুটে আসার মধ্যে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও টেকসই কোন সমাধান নেই এতে। তাই, তুমব্রু খালে মিয়ানমার কর্তৃক স্থাপিত অবৈধ সেতু অপসারণে কার্যকর কূটনীতিই হতে পারে একমাত্র ভরসা।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশ। E-mail: shahjahanmohammed38@gmail.com