তাওহীদুল ইসলাম নূরী:
জন্ম-মৃত্যু মানুষের জন্য আল্লাহর নিয়ামত। এই দুটো শব্দ সমার্থক মনে হলেও বিপরীত অর্থই প্রকাশ করে। জন্মের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে আগমন করে। আর, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আখিরাতের অনন্তকাল জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। জন্মের একটা ধারাবাহিকতা থাকলেও মৃত্যুর কোন ধারাবাহিকতা নাই। কার কখন কোথায় কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যু হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনেরই ভাল জানা আছে। জন্ম-মৃত্যুর এই অমোঘ নিয়মেই প্রতিদিন পৃথিবীতে মানুষের যাওয়া-আসার মিছিল চলমান। অতীতের নবী-রাসূল, তাদের অনুসারী এবং সে সময়কার অনান্য লোকেরা শত হাজার বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকত। কিন্তু হযরত মোহাম্মদ (স.), তাঁর অনুসারী এবং বর্তমান বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক আয়ুকাল ৭০ থেকে ১০০ এর মধ্যে। আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ুকাল ৭২.৮ বছর। এই ছোট্ট জীবন পার করেই আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে অনন্তকাল আখিরাতের পথে।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন। তারপরও মানুষ অতিমাত্রায় কৃতজ্ঞ” (সূরা হজ, আয়াত ৬৬)”। অন্যদিকে,একবার বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) তার প্রিয় সাহাবী হযরত আলী (র.)কে জিজ্ঞেস করেন “আলী, মৃত্যু সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?”। তখন হযরত আলী যখন উত্তরে “হে আল্লাহর রাসুল, আমি ফজরের নামাজ আদায় করে আর বিশ্বাস করতে পারি না যে যোহরের আদায় করতে পারব কিনা” বলেন তখন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) প্রতিত্তোরে বলেন, “আলী, আমি তো তোমাকে মদিনার সবচেয়ে জ্ঞানী মনে করতাম। জেনে রেখ, আমি ডান কাঁধে সালাম ফিরিয়ে আর বাম কাঁধে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে পারব এই বিশ্বাস করতে পারি না। মৃত্যুকে আমার এতটা কাছের মনে হয়”৷ অথচ, আজকাল আমাদের কী এক চালচলন! আমাদের কোন কর্মকাণ্ড দেখলেই মনে হয় না যে আমাদের মধ্যে মৃত্যু চিন্তা আছে কিংবা মরণ একদিন আমাদের ঘিরে বসবে। হত্যা,লুণ্ঠন,নেশা,জুয়া,ফিতনা-ফ্যাসাদ,প্রতারণা,গীবত,যুলুম,চাঁদাবাজি,সুদ-ঘোষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজেকে যেভাবে জড়িয়ে ফেলেছি আখিরাতে যে মহান আল্লাহর দরবারে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে সেটাই আমরা ভুলে গেছি।

মৃত্যু তথা আখিরাত অনিশ্চিত এক নিশ্চিত গন্তব্যের নাম। দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবন শেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনন্তকাল আখিরাতের পথ ধরতে হবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব সেসময় আল্লাহকে দিতে হবে। হত্যা,ফিতনা-ফ্যাসাদ দূরের কথা রাসূল (স.) বলেছেন কেউ যদি কারও দিকে অন্যায়ভাবে চোখ রাঙিয়ে তাকায় সেটার জন্যও আখিরাতে আল্লাহর দরবারে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত চিরস্থায়ী আখিরাতের কথা ভেবে কাটানো। আজকের তথা জীবনের প্রতিটি দিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে কাটাতে হবে। পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ বলেছেন,
“নিশ্চয়ই কখন কেয়ামত হবে তা শুধু আল্লাহই জানেন। তিনি মেঘ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করেন। তিনি জানেন জরায়ুতে কী আছে। অথচ কেহই জানে না আগামীকাল তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে এবং কেউ জানে না কোথায় তার মৃত্যু হবে। শুধু আল্লাহই সর্বজ্ঞ, সব বিষয়ে অবহিত।” (সূরা লোকমান, আয়াত ৩৪)। আর, যার মধ্যে এই ধ্যান-ধারণা কাজ করবে সে কখনো আখলাকে যামিমাহ তথা আল্লাহর নিন্দনীয় কোন আচরণে নিজেকে লিপ্ত রাখতে পারবে না।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (সূরা মূলক, আয়াত ০২)। হাদিসের এক বর্ণনায় আদর্শের বিশ্বমানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) বলেছেন “দুনিয়া হল আখিরাতের শস্য ক্ষেত্র”। অর্থাৎ দুনিয়াতে মানুষ যে আমল করবে আখিরাতে তার প্রতিদান তাকে দেয়া হবে। মনে রাখতে হবে দুনিয়ার সব সুখ একত্রিত করলে আখিরাতের এক মুহুর্ত সুখের সমান হবে না। একইভাবে দুনিয়ার সব কষ্ট একত্রিত করলেও আখিরাতের এক ফোঁটা কষ্টের সমান হবে না। তাই দুনিয়ায় ৬০-৭০ বছরের এই জীবন আমাদের এভাবে কাটাতে হবে যেন এই ছোট্ট জীবনের কল্যাণে আখিরাতের অনন্তকালের জীবন আমাদের সুন্দর ও সুখময় হয়।

তাওহীদুল ইসলাম নূরী
প্রাবন্ধিক, সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী।
শাহারবিল বাজার, চকরিয়া, কক্সবাজার।