বদরুল ইসলাম বাদল

বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বান। ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য মুলুক আচরণ ও স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে যার রাজনীতির পথ চলা।আর 04-06-21 তারিখ গৌরবময় জীবন নিয়ে আরব আমিরাতের সারজা প্রদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা আমৃত্যু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া আদর্শীক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ধন্য গোলাম রব্বানী।
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল ত্যাগের, ভোগের নয়। রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য হল জনগণের সেবা করার মত মহত কাজ করা। আর যেকোনো মহত কাজের জন্য ত্যাগ এবং সাধনার প্রয়োজন পড়ে।আবার রাজনীতি সমাজের কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রভাবিত একটি অংশ।তাই সমাজ বিনির্মানে, সমাজ পরিবর্তনে রাজনীতির ভূমিকাই সবচেয়ে অগ্রগণ্য।আর তাই রাজনীতিবিদদের ন্যায়পরায়ণ, সত্, উদার সর্বোপরি ত্যাগ ও নিষ্টার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে রাজনীতির আদর্শের ধারাকে সমুন্নত রাখতে হয়।কারণ নতুন সমাজ গড়ার পথে তাদের স্বচ্ছতা নীতিনৈতিকতা অন্যদের প্রভাবিত করে। গোলাম রব্বান বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে সেই শিক্ষা পেয়েছিলেন বলেই কোন ব্যক্তিগত প্রাপ্তির আশা করেনি কোন দিন। ক্ষমতা কিংবা পদের লালায়িত না হয়ে সব সময় সুস্থির রাজনীতির চর্চা করেন। তাই নির্মোহ ও সততায় বঙ্গবন্ধু আদর্শের রাজনীতির মাঠে কিংবদন্তি হয়ে থাকবে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বানের নাম।তিনি রাজনীতিকে ভোগবিলাসের জায়গা হিসেবে বিশ্বাসী ছিলেন না।কারণ দার্শনিকদের মতে”মানুষের মধ্যে ভোগবাদের সর্বোচ্চ লোভ দৃষ্টি গোছর হলে সমাজ ঠিকে থাকে না।এটি সমাজ বিশ্লেষণের গভীরতর উপলব্ধি। ”
বাঙ্গালির অধিকার আদায় বা জাতীয় মুক্তি অর্জনে আপোষহীন নেতা বঙ্গবন্ধু দর্শনের একনিষ্ঠ অকুতোভয় সিপাহসালার ছিলেন গোলাম রব্বান। এডভোকেট জহিরুল ইসলাম রচিত “বাংলাদেশের রাজনীতি ” বইয়ে দেখা যায় যে 1966 সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয়দফা নিয়ে বিশ্লেষণ এবং জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ভেওলা মানিক চরে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।সভাস্থলে যাওয়ার জন্য এডভোকেট জহিরুল ইসলাম এবং সাথের নেতৃবর্গ চকরিয়ার তরজঘাট দিয়ে মাতামুহুরি নদী পার হলে দেখতে পান শতাধিক ছাত্র লীগের নেতা কর্মীর উপস্থিতি। তারা জনসভায় আসা নেতাদের মিশিল সহকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র নেতাদের মধ্যে গোলাম রব্বান, শামসুল হুদা বি এস সি,সাজ্জাদ রহিম অন্যতম। এডভোকেট জহিরুল ইসলাম লিখেন “গোলাম রব্বান ছাত্র অবস্থা থেকে একজন নিবেদিত প্রান ছাত্র লীগ কর্মী ছিলেন এবং 71’সালে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন”।স্বাধীনতার পর সরকারের বহু উচ্চ পদে চাকরির সুযোগ পাবার পরও তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি নিয়ে থাকার আশা ব্যক্ত করেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কাছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী গোলাম রব্বান বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাজনীতির বীর পুরুষ হিসেবে অমর দৃষ্টান্ত রেখে যান।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির লড়াকু গোলাম রব্বান সব সময় মাথা উঁচু করে নিজের আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন।কোন লোভ লালসার কাছে আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী গোলাম রব্বান দক্ষ পরিশ্রমী সংগঠক এবং অপরিসীম রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ও ছিলেন।এ পর্যায়ে নব্বই দশকেরএকটি স্মৃতি উল্লেখ করছি।তখন প্রায় সময় অনেক ছাত্র সংগঠন নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ সভা করতো।তেমনি তত্কালীন জাতীয় ছাত্র লীগের আয়োজনে কক্সবাজার পাবলিক হলে এক প্রশিক্ষণ সভায় মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বানের সাথে পরিচয় হয় আমার।গুরুগম্ভীর দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান একজন বঙ্গবন্ধুপ্রান নেতা।অনুশীলন সভায় তিনি মানব সভ্যতার পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিক ইতিহাস আলোকপাত করে সাম্যভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণ মুলুক আলোচনা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা করেন। কারণ সাম্যতা ভিত্তিক সমাজ কাঠামো বিনির্মান না হলে হাজার বছরের বাংগালী জাতির আকাংকিত স্বাধীনতার মুল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।। তিনি বলেছিলেন রাজনীতি শুধু বক্তৃতা দেবার জায়গা নয়।ড্রয়িং রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি সাজিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত পরিচয়ে নিজেকে জাহির করা বা নেতা সাজা যায়।কিন্তু সুস্থির রাজনীতি চর্চা এবং আদর্শের ধারক হতে হলে রাজনীতি হল শিক্ষনীয় অধ্যায়। আদর্শ বোঝা, চর্চা এবং নিজেকে সত্ মানুষ হিসেবে তৈরি করা।নিজের ব্যক্তিগত কিছু পাবার জন্য নয় সমাজের জন্য দেশের জন্য কি করা গেল সেটাই বড় কথা। আজ উনার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে একটি কথা বলিষ্ঠ ভাবে বলতে চাই যে, নব্বই দশকে প্রশিক্ষণ সভায় উনার কথা সমূহ শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না।নিজে ধারণ করতো বলে বিশ্বাস থেকে বলেছিলেন। যার বাস্তব চিত্র তার পরবর্তী জীবনে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। তিনি রাজপথে কোন অপশক্তির কাছে আপোষ করে নাই।ধন সম্পদের লালসা করেনি।দখল বাজি করে নাই। এডভোকেট জহিরুল ইসলাম তার বইয়ে যথার্থ বলেছেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বান ‘র জীবনে তেমন কোন বৈষয়িক প্রাপ্তি নেই। ”
কিন্তু আজকের দিনে অনেকে দলকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে ব্যক্তিগত লাভের সিড়ি হিসেবে দেখে।কয়েক দিন মিশিল মিটিং এ যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে ফটোসেশান করে ত্যাগী নেতা হিসেবে জাহির করে। বড় কিছু পাওয়ার বাসনা করে ।আর অপ্রাপ্তি থেকে অনেকে হতাশ হয়ে নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হয়ে দলকে বিতর্কীত করে তুলে। রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা ও সফল রাজনীতিবিদের জীবনি থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণে সমস্যা গুলো সৃষ্টি হয় বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে। আজকের আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বানের রাজনৈতিক জীবন চিত্র পর্যালোচনা করলে রাজনীতিতে তার ত্যাগ এবং অবদান সমূহ জানা যাবে। বিনিময়ে তার কোন চাওয়া পাওয়ার ছিল না,সে শিক্ষাটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাই গোলাম রব্বানের মৃত্যুর পরে তার সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিবৃতি তুলে ধরছি।যাতে রাজনীতিতে তার অবদান ও ত্যাগের বিষয় টি বুঝতে সহজ হবে।বিবৃতি হল,তিনি “71-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলা মুজিব বাহিনীর গেরিলা কমান্ডার এবং 1 নম্বর সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম সমন্বয়কারী। গোলাম রব্বান 1966-67 সালে ছাত্রলীগ বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয় শাখার সভাপতি এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কক্সবাজারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন। আইয়ুব বিরুধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে 1967 সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি দীর্ঘ দিন কারাভোগ করেন। 1975 সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিন বছর কারাভোগ করেন। 1980 সালে বি এন পি কতৃক নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হন।” শুধু তাই নয় পরবর্তী সময়ে ও স্বৈরাচার সাম্প্রদায়িক বিরোধী আন্দোলনে ও সম্মুখ সারিতে ছিলেন।
এক বাক্যে স্বীকার করতেই হবে উনার গৌরব গাঁথা জীবন এইজনপদের বর্তমান এবং আগত প্রজন্মের অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা এবং দেশপ্রেমের উতকৃষ্ট উদাহরণ। তাই মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বানের স্মৃতি ধরে রাখা দরকার বলে মনে করি।উনার জন্মস্থান কক্সবাজার জেলা চকরিয়া উপজেলার ভেওলা মানিকচর যাওয়ার পথে মাতামুহুরি নদীর চকরিয়া পৌর সভার তরচঘাট-ভেওলা মানিকচর সংযোগ ব্রিজটি নির্মানের এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি। তাই ব্রিজটি বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ধন্য “বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বান ব্রিজ” নাম দিয়ে উনার প্রতি সন্মান সমুন্নত রাখার দাবি জানাচ্ছি, মাননীয় সাংসদ (চকরিয়া – পেকুয়া) জাফর আলম বি এ অনার্স এম এ।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কক্সবাজার জেলা, চকরিয়া উপজেলা, মাতামুহুরি উপজেলা (সাং) শাখা, চেয়ারম্যান চকরিয়া উপজেলা ,চকরিয়া পৌর সভা আওয়ামী লীগ শাখা এবং মেয়র চকরিয়া পৌরসভা।
আগষ্টের পনেরো তারিখ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবাদে গর্জে উঠে বঙ্গবন্ধু পাগল মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বান। যার জন্য সামরিক স্বৈরাচার জিয়া তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করে তিন বছর জেলে আটকে রাখে।তারপর ও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু আদর্শের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয় নাই।শোকের মাসে বঙ্গবন্ধু সহ সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বান সহ সকলের জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করার আবেদন মহান আল্লাহর কাছে। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কলামিষ্ট, নব্বই দশকের সাবেক ছাত্র নেতা।
badrulislam2027@gmail.com