আজাদ মনসুর:

কয়েকদিন ধরে লঘুচাপের কারণে অতিবৃষ্টিতে বন্যার কবলে দেশের সব কয়টি জেলার নিম্নাঞ্চল।

এমনিতেই বৈশ্বিক বৈরি পরিবেশ জীবনে আমাদের ভোগান্তীর অন্ত নেই।

সামান্য বৃষ্টিতে কক্সবাজারের শহর, শহরতলী আর বিভিন্ন উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো ডুবে থাকে পানিতে।

করোনার ধাক্কা, ভয়াবহ বন্যা এ যেনো মেঘ না চাইতে ‘বৃষ্টি’।

এগুলোতো শহর কেন্দ্রিক গল্প। গ্রামের অলিগলির অবস্থা আরও বেহাল।

আমার বিশ্লেষণটি আপনাদের অনেকের গায়ে আংগুল উঠানো মনে হতে পারে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো সকল জলযটের মূলেই নদী, শাখা নদী, ভরাটখাল, ছরাভরাট, দখল, দূষণ, নদীর নাব্যতা সংকটসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতাই অন্যতম।

দেখছি পুরো শহর কিংবা এলাকার বর্জ্যগুলোরও ঠাঁই হচ্ছে নদী বা খালের বুকে।

এটা বড় কথা নয়, শুধু ভরাট করছেন না তো!

-এতে আগে ক্ষেত করছেন, করছেন গরু পালনের ঘর, গোখাদ্যের জন্য খড়ের স্তপসহ আরো কত কি।

তারপর আর কি করছেন?

একদিন সকালে উঠে দেখবেন ওই ভরাটকৃত নদী, ভরাটখাল, ছরার দু’পাশ ভরাট করা স্থানে স্থাপনা করে ফেললেন। এতে বাড়ি, দোকানসহ অনেক কিছুই যে করে বসলেন চিন্তা করেননি আপনার প্রজন্মের কথা।

আপনার বাড়ির পাশের নদী, শাখা নদী কিংবা ভরাটখালি পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। আপনার বাড়ি-উঠোনে পানি ঢুকতে দেখেননি কখনও। আমিও দেখিনি।

আমার দেখা নিজের এলাকাটির কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

১৯৯৮ সাল থেকে আজোব্দি কিছু স্মৃতিরোমন্থনে নিয়ে যায় আপনাদের।

শৈশবের স্মৃতিহীন কোনো আত্মা বেঁচে থাকতে পারে না কখনো। শৈশবের স্মৃতির কথা মনে করতেই চোখের সামনে ভেসে আসে কতনা মধুর স্মৃতি।

যুগের পরিক্রমায় কিংবা সময়ের আবর্তনে নয়তো মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতি যে কারণরেই হোক না কেন নিজেদের অজান্তে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অনেক মূল্যবান কিছু।

আধুনিকতা আমাদের স্মৃতির পাতাকে অন্তসারশূন্য অবস্থায় নিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে।

দুইদশক আগের ছেলে-মেয়েদের শৈশব ছিল সোনালী শৈশব। তারও আগের শৈশবের কথা বাদই দিলাম।

বেশি দূরে যাব না। দুইযুগ শুধু পেছনে যাচ্ছি। প্রাথমিক পর্যায়ের অনেক কথা মনে আছে আবার হারিয়েও ফেলেছি।

বাড়ির পাশের ঈদগাঁও নদী ও ভরাটখালটি আমার শৈশবের নদী। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে সে আমার সঙ্গে মিশে আছে। অতি নিবিড়ভাবে ও সংগোপনে।

নিজে দেখিনি, বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে শোনা সাম্পানের ভটভট শব্দে আমার আদি এলাকা নয়াবাদখ্যাত ঈদগাঁও দক্ষিণ মাইজ পাড়া গ্রামটিতে মানুষদের সাথে মিশে আছে অনুপম জীবনযাত্রা।

‘ঈদগাঁও নদী, নাশিখাল দিয়ে বয়ে চলা ভরাটখালটি কালিরছড়া ও চৌফলদন্ডি দিয়ে প্রবাহমান।

আমাদের বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার চমকপ্রদ যাপিত জীবনে দুকূলের মানুষকে শুধু দুহাত ভরে দিয়েছে এসব নদী ও খাল। মানুষের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে, ভাগ্যের চাবি ঘুরিয়ে দিয়েছে প্রাণের ভরাটখাল ও ঈদগাঁও নদী। মূল কথা কিছু মানুষের জীবিকার অন্যতম বাহন ছিল।

শুধু তা নয়, বর্ষায় যতই বৃষ্টি হোক কোন দিন লোকালয়ে পানি ঢুকতে দেখিনি। স্কুল জীবনে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি ঈদগাঁও নদীতে। এখন স্কুলে সাঁতার প্রতিযোগিতা হয় না।

নদী ও খাল নিয়ে নানা মুনির নানা মত।
দেশের বিভিন্ন শহরের ভেতরের ও আশপাশের নদী-খালগুলোর দখল এবং দূষণের বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও বাস্তবতা হল, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ অশুভ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

একটি সমীক্ষা বলছে, ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এখন এটার তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার এখন নদী, খাল, জলাশয় দখল মুক্ত করতে গঠন করেছে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এই কমিশনের কাজ হচ্ছে নদী-খাল-বিল-জলাশয় রক্ষা, দূষণমুক্ত রাখা, পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।

নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর সুপারিশের মাধ্যমে নাব্যতা রক্ষা ও নৌপথ গড়ে তোলাও এ কমিশনের কাজ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে এ কাজ জোরদার করে কমিশন। যেকোনো মূল্যে নদ-নদী দখল ও দূষণমুক্ত রেখে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত রাখতে কাজ করছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

সরকার নদী, খাল দখল-দূষণের শাস্তি কঠোর করে ক্ষমতা বাড়িয়েছে কমিশনের।

এজন্য ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০২০’ এর খসড়া করেছে কমিশন। খসড়া আইনে নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

আমার এলাকার মানুষদের অনেক আগে থেকে সচেতনতা বাড়ানো হয়েছিল।

সর্বশেষ এলাকার কৃতি পুরুষ কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষের চেয়ারম্যান লেফটেনেন্ট কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত ফোরকান আহমদ স্থানীয় মসজিদে মসজিদে ঘোষণাও দিয়েছিলেন ভরাটখালটি যারা দখল করেছেন তাদের ছেড়ে দিতে এবং আর যাতে দখলের পায়তারা না করেন।

এরপরেও দখল ও দূষণ থেমে নেই আমার শৈশবের ভরাটখাল ও ঈদগাঁও নদীটি।

আপনারা যারা নদী ও খাল ভরাট করেছেন একটু চিন্তা করুণ। আপনার সময় নদী ও খালের অবস্থা কেমন ছিল? আপনার কাল শেষ প্রায়।

আপনার পরবর্তী প্রজন্মটি ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির জন্য একটি বাসযোগ্য নিরাপদ কাল উপহার দিবেন।

আপনি হয়তো এখন বুঝতে পারছেন না। এতগুলো টাকা খরচ করে স্থাপনা তৈরি করছেন। একদিন আপনার ওই স্থাপনা উচ্ছেদ হবে নিশ্চিত।

ইতোমধ্যে বাঁকখালী নদী দখল যারা করেছেন তাদের তালিকা করে মামলা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বড় বড় রাগবদের তালিকা করে মামলা করে স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে।

যারা নদী, খাল দখল করেছে তাদের নব্য রাজাকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাও করা হয়েছে।

একটি সুন্দর আগামী বাংলাদেশ বিনির্মানে আপনার প্রজন্মকে শ্বাস নেওয়ার একটি পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবার দায়িত্ব আপনার।