সিবিএন ডেস্ক:
আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রায় এক যুগ হতে চললো। বড় একটি দলের কিছু শাখা-উপশাখা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে কোনোমতে একটি সংগঠন বানিয়ে নামের শেষে ‘লীগ’ জুড়ে নিজেদের মূল দলের শরিক ভাবতে শুরু করেছে ভুঁইফোড় অনেক গোষ্ঠী। দিনকে দিন সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। পাড়া-মহল্লা, গ্রামে তো আছেই, শুধু রাজধানীতেই ‘লীগ’ জুড়ে দেওয়া সংগঠন পাওয়া যাবে কমপক্ষে তিন শ’।

অনুসন্ধানে কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি এসব সংগঠনের। শুধু ফেসবুকে একটি পেইজ কিংবা দিবসভিত্তিক কিছু ব্যানার-ফেস্টুন দেখা যায়। আওয়ামী লীগ থেকেও এদের লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ এদের কর্মকাণ্ডে সমালোচনার ভাগিদার হতে হচ্ছে মূল দলকেই।

এসব ‘লীগ’ নামধারী সংগঠনের হর্তাকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনাতেই তাদের সংগঠন চলছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নামসর্বস্ব এসব ‘লীগ দোকানদাররা’ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কিছু নেতার আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন কিছুদিন। এরপর তাদের সঙ্গে সেলফি তোলেন। ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাইরে ঘোরাঘুরিও করেন নিয়মিত। শীর্ষপর্যায়ের কোনও নেতার কাছে মুখটা পরিচিত হলেই লীগ শব্দ জুড়ে খুলে বসেন রাজনীতির ‘দোকান’।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় লীগ নামের এসব ‘দোকান’ বেড়েই চলছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন রয়েছে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ। এ ছাড়া অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিব), মহিলা শ্রমিক লীগসহ কয়েকটি সংগঠন আছে আওয়ামী লীগের। দলের গঠনতন্ত্রে লীগ নামে আর কোনও সংগঠনের ভিত্তি নেই।

গত দুই দিন ধরে ‘লীগ’ নামে নতুন আরও দুটি ‘সংগঠন’ দেখা গেলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এগুলো হলো ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ ও ‘জনসেবা লীগ’।

চাকারিজীবী লীগের পোস্টারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটির দাবি, গত দু-তিন বছর ধরেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছে তারা।

নামসর্বস্ব এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনির। পোস্টারে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক হিসেবে সাইফুল ইসলাম ইমনের ফোন নম্বর দিয়ে তাতে পদ প্রত্যাশীদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

সাইফুল ইসলাম ইমন বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ এখনও (আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে) অনুমোদন পায়নি। দুই থেকে তিন বছর ধরে ফেসবুকে আমাদের প্রচার-প্রচারণা চলছে। অনুমোদনের চেষ্টা চালাচ্ছি।’

সংগঠনের উদ্দেশ্য কী, জানতে চাইলে ইমন জানান, ‘আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর মতোই কাজ করতে চান তারা।

বাংলাদেশ জনসেবা লীগের চেয়ারম্যান ডা. ইয়াছিন হাওলাদার মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক জসীম উদ্দিন। গত ৫ জুলাই জামালপুরে ১৫ সদস্যের একটি কমিটিও অনুমোদন দিয়েছে সংগঠনটি। সারাদেশে কার্যক্রম চলছে জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে আমাদের সংগঠন কাজ করছে। আমাদের কাজ জনসেবামূলক।’

চেয়ারম্যান ইয়াছিন হাওলাদার মঞ্জু বলেন, তাদের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। সারাদেশে ৩০টি জেলা-কমিটি রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের দিক-নির্দেশনায় জনসেবা লীগ পরিচালিত হয় বলে জানান তিনি।

চাকরীজীবী লীগের নেতা হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আমার উপদেষ্টা, আমার ভাইয়া। ভাইয়াকে বললাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনি না থাকলেতো কেউ না কেউ থাকবে। চুমকি আপা, কাদের ভাই, গোলাপ ভাই, বিপ্লব বড়ুয়া ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে পারিনি।’

নামসর্বস্ব যত ‘লীগ’
১. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ ২. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ ৩. আওয়ামী প্রচার লীগ ৪. আওয়ামী সমবায় লীগ ৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ ৬. আওয়ামী ছিন্নমূল হর্কাস লীগ ৭. আওয়ামী মোটরচালক লীগ ৮. আওয়ামী তরুণ লীগ ৯. আওয়ামী রিক্সা মালকি-শ্রমিক ঐক্য লীগ ১০. আওয়ামী যুব হর্কাস লীগ ১১. আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ ১২. আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ ১৩. আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ ১৪. আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ ১৫. আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ ১৬. আওয়ামী যুব সাংস্কৃতকি জোট ১৭. বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ ১৮. বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ ১৯. বঙ্গবন্ধু একাডেমি ২০. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরষিদ ২১. বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, ২২. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ ২৩. বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ ২৪. বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, ২৫. ২৬. বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ ২৭. বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ ২৮. বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন ২৯. বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ ৩০. বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ ৩১. বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ ৩২. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ ৩৩. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ ৩৪. বঙ্গবন্ধু গবষেণা পরিষদ ৩৫. বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ ৩৬. আমরা মুজিব সেনা ৩৭. আমরা মুজিব হবো ৩৮. চেতনায় মুজিব ৩৯. বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ ৪০. মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ ৪১. নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী ৪২. দেশীয় চিকিৎসক লীগ ৪৩. ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ ৪৪. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ ৪৫. নৌকার নতুন প্রজন্ম ৪৬. ডিজিটাল ছাত্রলীগ ৪৭. ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ ৪৮. ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ ৪৯. বাংলাদশে আওয়ামী পর্যটন লীগ ৫০. ঠিকানা বাংলাদেশ ৫১. জনতার প্রত্যাশা ৫২. রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি ৫৩. জননেত্রী পরষিদ ৫৪. দেশরত্ন পরিষদ ৫৫. বঙ্গমাতা পরিষদ ৫৬. বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ ৫৭. আমরা নৌকার প্রজন্ম ৫৮. আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট ৫৯. তৃণমূল লীগ ৬০. একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি ৬১. আওয়ামী প্রচার লীগ, ৬২. সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ ৬৩. বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তি লীগ ৬৪. আওয়ামী শিশু লীগ ৬৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ৬৬. আওয়ামী তরুণ প্রজন্ম লীগ, ৬৭. আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ, ৬৮. বাংলাদেশ জনসেবা লীগ।

বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ নামেই রয়েছে চারটি সংগঠন।

নিয়ম হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনও সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর অনুমোদন নিতে হয়। তথাপি অনুমোদন ছাড়াই নামসর্বস্ব সংগঠন নামের মধ্যে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এসব নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘লীগ নাম ব্যবহার করে যারা এসব করে বেড়াচ্ছে তারা প্রতারক। এদের বিরুদ্ধে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হানিফ বলেন, এর আগে সারাদেশে আমরা আড়াই শ’ প্রতারক সংগঠনের তালিকা করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিছুদিন এদের তৎপরতা বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। এদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘এগুলো আওয়ামী লীগের অনুমোদিত বা সমর্থিত সংগঠন নয়। কিছু সুযোগসন্ধানী চক্র এসব করছে। আমাদের কিছু নেতা সরল বিশ্বাসে এসব চতুর ব্যক্তিকে ছবি তুলতে, সেলফি তুলতে অনুমতি দেন। এসব ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা অব্যাহত রেখেছেন তারা। যে কোনও নামে যে কোনও নাগরিকের সংগঠন করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এরা তো আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে প্যাড-সর্বস্ব সংগঠন করে দলের অর্জন ম্লান করছে। এই অপতৎপরতা বন্ধে আওয়ামী লীগ কাজ শুরু করেছে।’ -বাংলা ট্রিবিউন