সিবিএন ডেস্ক:
করোনা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় নিয়ে বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের আকুল আবেদন জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর বিজ্ঞাপনে করোনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্যখাতের যেসব ব্যয় হয়েছে তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রীর কেনাকাটার বিষয়ে বিজ্ঞাপনে কিছু বলা হয়নি।

এদিকে গত মাসে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে করোনা চিকিৎসার কেনাকাটা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তাতে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী করোনা পরীক্ষার কিটসহ আরও কিছু কেনাকাটার তথ্য দেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন এবং বিজ্ঞাপনের কেনাকাটার কিছু ক্ষেত্রে গরমিল পাওয়া গেছে।

প্রতি ডোজ টিকার দাম তিন হাজার টাকা

বিজ্ঞাপনে বলা হয়, এক কোটি এক লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা কেনা হয়েছে। প্রতি ডোজ তিন হাজার টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা বলে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড কিনতে সব খরচ মিলিয়ে ৫ ডলার হয় বলে ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছিল। চীন থেকে ১০ ডলারে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব অনুমোদন হলেও সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি।

দেশে এখন পর্যন্ত চারটি টিকা এসেছে, এগুলো হলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্টাজেনেকা, সিনোফার্ম, ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোভিশিল্ডের ১ কোটি ২ লাখ, ফাইজারের ১ লাখ ৬০০, সিনোফার্মের ৩১ লাখ, মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এই খাতে অর্থ ব্যয়ের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটির যৌক্তিকতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন।

বিজ্ঞাপনে কোভিড পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৫ লাখ ৬ হাজার ৭৮১ জনের। এখানে হিসাব দেখানো হয়েছে টেস্ট খরচ ৩ হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া হিসাব কী বলে?

গত জুনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট কেনার একটি হিসাব তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সিএমএসডি ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৭ জুন পর্যন্ত ২২ লাখ ৫০ হাজার আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট কিনেছে ৪০১ কোটি ২৫ লাখ টাকায়। হিসাবে প্রতিটি টেস্ট কিটের দাম পড়ে এক হাজার ৭৮৩ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারেশন প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ ৫৬ হাজার আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট কেনা হয় ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ৩১ হাজার ১৪২ টাকায়। সেই হিসাবে প্রতি কিটের দাম পড়ে এক হাজার ৩৯৯ টাকা।

সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, দুই দফায় তিন লাখ করে এন্টিজেন টেস্ট কিট কেনা হয়েছে যথাক্রমে ১২ কোটি ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং ১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকায়। এক্ষেত্রে প্রথম দফায় প্রতিটি এন্টিজেন টেস্ট কিট’র দাম পড়েছে ৪২২ টাকা ৪৫ পয়সা এবং দ্বিতীয় দফায় পড়েছে ৪২৫ টাকা। এ ছাড়া ৯৯ হাজার ৯৩৬টি আরটি-পিসিআর কিট কেনা হয় চার কোটি ৪২ লাখ ৪২ হাজার টাকায়। যার প্রতিটির দাম পড়ে ৪৪৩ টাকা। আর তিন কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় কেনা হয় এক লাখ টেস্ট কিট। যার প্রতিটির দাম ৩০৬ টাকা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কোভিড টেস্ট করার জন্য এই দুই ধরনের আরটি-পিসিআর কিটের সঙ্গে আরও একটি করে বিশেষ ধরনের কিটের প্রয়োজন হয়। যার প্রতিটির দাম ৫ থেকে ৭শ’ টাকার বেশি নয়। এক্ষেত্রে এ দুই ধরনের rt-pcr টেস্ট কিট’র দাম সর্বোচ্চ এক হাজার টাকার বেশি পড়ার কথা নয়।

বিষয়টি নিয়ে কোভিড সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসক জানান, করোনা টেস্টে আমাদের দেশে যেসব কিট ব্যবহার করা সেগুলো সাধারণ মানের। এই কিটে করোনার ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে বিবেচিত সেগুলো ধরতে পারে না। একারণে এখানে ‘ফলস নেগেটিভ’ রিপোর্টের সংখ্যা অনেক। এসব কিটের মাধ্যমে টেস্টের জন্য তিন হাজার টাকা খরচ অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া প্রতি রোগীর পেছনে ব্যয় দুই লাখ টাকা

এদিকে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক লাখ রোগীর জন্য প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা করে গড়ে ১০ দিনে প্রত্যেক জনের খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা করে। এক্ষেত্রে তাদের মোট খরচ হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

১০০টি কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার জন্য ৩৫০ কোটি টাকা এবং ৯৭টি ল্যাব স্থাপনের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথাও বলা হয়েছে বিজ্ঞাপনে। এ ছাড়া করোনা চিকিত্সার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, চিকিত্সকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেল ভাড়া এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে ২০০ কোটি টাকা প্রদান করেছে।

কত টাকার মাস্ক?

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে মাস্ক কেনাকাটার বিষয়ে কোনও তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। সম্প্রতি সংসদে মাস্ক কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেছিলেন, মাস্ক কেনাই হয়নি সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন আসছে কেন।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল সেখানে প্রায় তিনশো কোটি টাকার সার্জিক্যাল, এন৯৫ ও কেএন-৯৫ মাস্ক কেনার তথ্য রয়েছে।

ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কোভিড ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারেশন প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড়ে প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম পড়েছে ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা। একই প্রকল্পে প্রতিটি এন-৯৫ মাস্কের দাম পড়েছে ২৯৩ টাকা।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই প্রকল্প থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সার্জিক্যাল, এন ৯৫ এবং কেএন৯৫ মাস্ক কিনতে খরচ হয়েছে ৩৯ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৩৩৩ টাকা। দেখা যায়, সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয় মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৪০০টি। এতে খরচ হয় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯৩ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি মাস্কের দাম পড়েছে ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা। ওই প্রকল্পের আওতায় এন-৯৫ মাস্ক কেনা হয় ৫ লাখ ২৯ হাজার ৬২০টি। গড়ে প্রতিটির দাম পড়েছে ২৯৩ টাকা ৭৭ পয়সা। আর কেএন-৯৫ মাস্ক কেনা হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার। গড়ে প্রতিটির দাম পড়েছে ৪২৮ টাকা।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ৭ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) মাধ্যমে ২৬৬ কোটি ১৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায় তিন ধরনের মাস্ক কিনেছে। সিএমএসডির মাধ্যমে কেনা হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক। খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ২৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। সিএমএসডির প্রতিটি মাস্কের দাম পড়েছে ২১ টাকা ৭২ পয়সা। তারা ২৭ লাখ ৮৫ হাজার ৮শ’ এন৯৫ মাস্ক কিনেছে ২১৮ কোটি ৩৬ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। প্রতিটির দাম পড়েছে টাকা ৭৮৩ টাকা ৮৫ পয়সা। এ ছাড়া সাত লাখ ৬৫ হাজার কেএন-৯৫ মাস্ক কিনেছে ২৪ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। প্রতিটির দাম ৩২০ টাকা ৫৯ পয়সা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশিদ আলম এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুই মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন ও অধ্যাপক নাজমুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্যের সমালোচনার জবাব বিজ্ঞাপনে

এদিকে বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে সংসদের ভেতর-বাইরের নানা সমালোচনার জবাব দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাবে বলা হয়, দেশে করোনা মহামারি প্রতিরোধে কঠোর সমালোচনা করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজন ও কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর দায় চাপিয়ে যে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তার অনেকগুলোই অনির্দিষ্ট ও অত্যন্ত ঢালাও এবং অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্যনির্ভর ছিলো না। মহামারি মোকাবিলার সময় এরকম অভিযোগ দেশের মানুষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হতাশ করে তুলতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নিবেদিতভাবে দায়িত্বপালন করা স্বাস্থ্যমস্ত্রীর প্রতি এই দুর্যোগের সময়ে ব্যক্তিগত এবং শালীনতাবর্জিত আক্রমণও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ও হতাশাজনক।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গত বছরের বাৎসরিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, আমরা এখানে বিনয়ের সঙ্গে তাদের এবং দেশবাসীর অবগতির জন্য উল্লেখ করতে চাই, আমরা যদি বিদেশ থেকে চুক্তি মোতাবেক ক্রয়কৃত ভ্যাকসিন নির্ধারিত সময়ে পেয়ে যেতাম, তাহলে এডিপি বাস্তবায়ন দাঁড়াতো ৮৫%। সামগ্রিকভাবে এডিপির বাইরে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখার পাশাপাশি নন করোনা খাতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার সেবা দিয়েছি। যদি নিয়মিত বাজেটে বাস্তবায়ন ৬৫ শতাংশ করা হয়, করোনার এই অতিরিক্ত কাজ যুক্ত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিগত বছরে বাস্তব বাৎসরিক কাজ ১৩০% এ দাঁড়াবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোনও কাজ হয় না- এমন অভিযোগের জবাবে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিয়মিত এডিপির বাইরে কেবল করোনা সেবায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কাজ করেছে। এতে কোনও খাতে কত ব্যয় হয়েছে তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়।