আবদুর রহমান খান

(জুন ২৭ )

কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস ঘোষণার তিনদিনের মাথায় রোবার (২৭ জুন) গভীর রাতে জম্মুতে একটি সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা হয়েছে।

জম্মু বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর স্টেশনে পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে দু’টি বিস্ফোরণ হয়েছে। সংবাদ সংস্থা সূত্রে প্রকাশ, ড্রোনের সাহায্যে ওই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আজ (রোববার) ভোর ১ টা ৩৭ ও ১ টা ৪২ মিনিটে দুটি বিস্ফোরণ হয়। প্রথমটি বিমানবাহিনীর প্রযুক্তি বিভাগ চত্বরে একটি ভবনের উপরে এবং দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয় খোলা জায়গায়। যে ভবনটির ছাদে বিস্ফোরণ হয়, তার উপরে গর্ত তৈরি হয়েছে। এছাড়া সামরিক স্থাপনার তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বিমানবাহিনীর আত্মবিশ্বাস এবং মনোবলের ওপর একটা আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে এ হামলাকে।

রোববার রাতের এ আকস্মিক হামলায় বিমানবাহিনীর উইং অফিসার অরবিন্দ সিংহ ও লিডিং এয়ারক্র্যাফ্টম্যান এসকে সিং আহত হন। কিন্তু কারোরই আঘাত গুরুতর না হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে, ওই বিস্ফোরণের পরেই আম্বালা, পাঠানকোট ও অবন্তিপুরা বিমান ঘাঁটিতে হাই এলার্ট জারি করা হয়েছে।

এদিকে, দেশের কোনও সামরিক ঘাঁটিতে এই প্রথম ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটল বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমধ্যম। সেকারণে বিস্ফোরণের তীব্রতা বেশি না হলেও ভারতীয় বিমানবাহিনী ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ গুরুফত্ব দিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে। রোববার সকালেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন এয়ার মার্শাল বিক্রম সিং। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং আজ সকালে সহকারী বিমানবাহিনীর প্রধান এইচএস অরোরার সঙ্গে কথা বলেন।

তদন্তকারীরা মনে করছেন, বিমানবাহিনীর স্টেশনে মোতায়েন যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারগুলোকেই টার্গেট করা হয়েছিল। কিন্তু কোনওভাবে ড্রোন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রীয় বোমা বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দল ঘটনাস্থলে তদন্ত শুরু করেছে।

কাশ্মীরী নেতাদের মোদির আশ্বাস

ভারত দখলীকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের ১৪ জন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে তার সরকারী ব আসভবনে বৈঠক করেছেন

জম্মু ও কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যেই এই বৈঠক আয়োজন করা হয়। এতে মোদি আশ্বাস দেন যে, কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হবে। তবে তা দেয়া হবে সঠিক সময়ে। অপরদিকে জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

২০১৯ সালের ৫ই আগস্ট কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন একতরফাভাবে বাতিল করার পর এই প্রথম জম্মু-কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসে মোদি। এতে অল পার্টিস হুরিয়াত কনফারেন্স (এপিএইচসি) নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

বৈঠকের পর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি মেহবুবা মুফতি ইন্ডিয়া টুডে’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে পুনর্বহাল করা না হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না ।

মেহবুবা মুফতি বলেছেন, আমি জানি এত সহজে ৩৭০ ও ৩৫ এ ধারা ফেরাবে না কেন্দ্রীয় সরকার। তবে কোথাও না কোথাও এর প্রক্রিয়া শুরু করতেই হবে। আমরা এর জন্য লড়াই করছি।

মেহবুবার অভিযোগ, জম্মু ও কাশ্মীরের ওই বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে সংবিধানের অধিকারকে খর্ব করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংবিধান কাশ্মিরীকদের যে অধিকার দিয়েছিল, তাকে খর্ব করা হয়েছে। নিজেদের সুবিধার জন্য সরকার কাশ্মীরের এই মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস অর্জন ও সংবিধানের মর্যাদা ফেরাতে ৩৭০ ও ৩৫ এ ধারা ফিরিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে জানান মেহবুবা। তার মতে, জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা সবথেকে বেশি দরকার। না হলে, কোনো ধরণের নির্বাচনের প্রয়োজন নেই।

দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক করে শ্রীনগর ফিরে এসে ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রধান ফারুক আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, এ বৈঠকেও আমাদের অনাস্থার মাত্রাটা প্রকাশ করা হয়েছ হয়েছে। আমরা কাশ্মীরী নেতারা বলেছি, রাজ্য সভার নির্বাচনের আগে জম্মু কাশ্মীরের স্বতন্ত্র মার্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে।

এর আগে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সেসময় কংগ্রেসসহ একাধিক দল বিজেপি সরকারের এমন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছিল।

কাশ্মীর নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক প্রসঙ্গে সেদিন বিকেলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘কাশ্মীর থেকে রাজ্যের মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? কোভিড মোকাবিলার মতো কাশ্মীর ইস্যুতেও মোদী সরকারের সমালোচনা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে সবকিছুই শেষ হয়ে যায়। দেশের কোনও অর্থই থাকে না। এই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে বিশ্বমঞ্চে ভারতের বদনাম হয়েছে।’

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী জাতীয় কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা পাঁচটি দাবি রেখেছেন। ‘কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া, অবিলম্বে বিধানসভা নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানো, সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ডোমইসাইল চালু এবং কাশ্মীরি পন্ডিতদের পুনর্বাসন। এই পাঁচটি দাবি প্রধানমন্ত্রীর সামনে রাখা হয়েছিল।‘

এদিকে সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর জানিয়েছে , বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, , ‘‘রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু সব দলের উচিত দেশের ও মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করা। দিল (মন) থেকে দূরত্ব ও দিল্লি থেকে দূরত্ব মুছে ফেলতে হবে।’’

পাকিস্তান বলছে “আই ওয়াস”

ওদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীরের সর্বদলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠককে ‘আইওয়াশ’ বলে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তান। একই সঙ্গে একে ‘ফ্লপ শো’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।

পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি এ বিষয়ে রাজধানী ইসলামাবাদে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, মোদির এ বৈঠকটি ছিল আইওয়াশ। সর্বোপরি একে মোদির জনসংযোগের মহড়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে কিছুই অর্জিত হয়নি।

তিনি বলেছেন, ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করায় যেসব কাশ্মীরি নেতা সুপ্রিম কর্মরতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তাদের খুবই যৌক্তিক কারণ আছে। তিনি আরো বলেন, কাশ্মীরের আগের অবস্থা ফিরে পাওয়ার দাবি জানানো সত্ত্বেও কাশ্মীরি নেতারা শূন্য হাতে ফিরে এসেছেন। মোদি সরকার বলেছে, তারা শুধু এ বিষয়টি বিবেচনা করবে ডিলিমিটেশন এবং তথাকথিত নির্বাচনের পরে।

শাহ মেহমুদ কুরেশি বলেন, মোদি যা বলেছেন, তা হলো যথাযথ সময়ে কাশ্মীরের আগের অবস্থা ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের যে সমস্যা তার উত্তর শুধু রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে নেই। কুরেশি বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর এসব হলো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।##