শ্যামল রুদ্র :
পাহাড়ে মৌসুমী ফলফলারি পরিবহনে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। প্রতিবছর এই মৌসুমে প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়। আলোচনা সমালোচনায় মুখর থাকে গোটা পার্বত্যাঞ্চল। পার্বত্য জেলা পরিষদ, বাজার ফান্ড ও পৌরসভার বিরুদ্ধেই ওঠেছে অভিযোগের তীর। পাহাড়ে উৎপাদিত আম,কাঁঠাল,আনারস, কলাসহ ফলফলারি জেলার বাইরে পরিবহনে গত কয়েক বছর ধরে বেশ সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। পুরো এলাকায় চাউর হচ্ছে এখন এ খবর। অতিরিক্ত টোল ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের ফেলেছে বেকায়দায়। প্রতিবাদ জানালে শক্তিশালী সিন্ডিকেটভুক্ত দালাল চক্রের হাতে হন নিগৃহীত। ইতিপূর্বে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের শরণাপন্ন হয়েও সমস্যার উত্তরণ হয়নি। গৎবাঁধা মুখস্থ প্রতিশ্রুতি শুনে শুনে ক্লান্ত ব্যবসায়ী মহল। তাঁদের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে কৃষিমন্ত্রণালয় কিংবা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ জরুরি। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে তাঁদের। এখন সমতল জেলার ব্যবসায়ীরা পাহাড়ের পণ্য ক্রয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাগান মালিকেরা। অতিরিক্ত টোল দেওয়ায় বিপণন খরচ বেড়ে যায়। এর খেসারত দেয় ভোক্তারা। একদিকে ন্যায্য মূল্য পায় না ব্যবসায়ী অন্যদিকে ভোক্তাদের দিতে হয় অতিরিক্ত দাম। প্রতিবছর এই সময় ব্যবসায়ীদের কাছে এ সমস্যা প্রকট হয়ে হাজির হয়। দীর্ঘদিনেও কোন সুরাহা না হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন তাঁরা। বাগান মালিক সমবায় সমিতির উপদেষ্টা ও সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য অনিমেষ চাকমা রিংকুর ভাষ্য অনুযায়ী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরে ব্যবসায়ীরা এখন ক্লান্ত। এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দোষ চাপায়। এ দুর্ভোগের চিত্র কৃষি মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ ও পার্বত্যাঞ্চলের সেনা রিজিয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি। বৈশ্বিক মহামারি করোনা কালে পণ্য সামগ্রী পরিবহনে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই প্রচন্ড সমস্যায় পড়েছেন আবার অতিরিক্ত টোল আদায় তাঁদের কাছে যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পার্বত্যাঞ্চল যেহেতু দেশের বিশেষ অঞ্চল তাই টোল কেন্দ্রগুলোয় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ালে হয়তো সুফল পাওয়া যাবে।
ত্রিমুখি যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাগান মালিক ও ফল ব্যবসায়ীরা হয়রানি বন্ধ চান। ২৪,জুন বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে মানব বন্ধন করেন। তাঁদের সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবাদ জানান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়,স্থানীয় বাজারেও রয়েছে বিপণন সমস্যা। পাহাড়ের ঢালে, উঁচু টিলায় অবস্থিত বাগানের ফলফলারি ক্রুটিপূর্ণ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার কারণে কৃষক সঠিক মূল্য পায় না। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। দ্রুত বাজারজাত করা যায় না। ফলে বাগানে কিংবা মাঝ পথে পচে নষ্ট হয়। কাঁধে,সাইকেল ও রিকশায় এবং ভ্যান গাড়ি ও খোলা জিপে (চাঁদের গাড়ি) বাজারে এনে স্তুপাকারে রাখা হয়। দুর্গম এলাকার চাষিরা কষ্টকরে বাজারে এনে ফসলের ন্যায্যমূুল্য পায় না। রয়েছে মাস্তান,চাঁদাবাজদের উৎপাত। পড়তে হয় দালাল ও ফরিয়াদের খপ্পরে। দালালদের মর্জিতে উঠা নামা করে দাম। একজোট হয়ে দাম হাঁকে। বাজারমূল্য অনেক কমে যায়। উপরন্তু রয়েছে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংস্থার স্থানীয় কর। নিরূপায় কৃষক অনেক সময় রাগ করে ফলফলারি বাজারেই ফেলে যান। এ রকম দু:খজনক ঘটনা হরহামেশাই দুর্গম পাহাড়ি বাজারগুলোয় দেখা যায়। বিপণন কর্মকর্তা বাজার গবেষক মো. ফরহাদ হোসেন বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন। মাঝে মধ্যে বাজার অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে ক্রটিবিচ্যুতি দূর করার চেষ্টাও করেন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়েও ওয়াকবিহাল তাঁরা। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ রকমই বললেন। খাগড়াছড়ির অপর বাজার গবেষক তুষার কান্তি চাকমার মন্তব্য, এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রশাসসিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে জরুরি।
অন্যদিকে,পাহাড়ের কোথাও হিমাগার নেই। এটিও বড় সমস্যা। অবিক্রিত পণ্য সংরক্ষণও করা যায় না। প্রতি বছর পচে গলে নষ্ট হয় বিরাট একটা অংশ। ক্ষতিগ্রস্ত হন স্থানীয় কৃষক। আর্থিক ক্ষতির কারণে ফসল উৎপাদনে উৎসাহ পান না। এলাকায় হিমাগার স্থাপনে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে এ ধরনের উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হওয়ায় অতীতের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুন বেশি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন। বর্তমানে তিন পার্বত্যজেলায় শুধুমাত্র আমই চাষ হয় ১৩ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এর বাইরে পাহাড়ে হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলা-উপত্যকা জুড়ে কাঁঠাল, লিচু, আনারস, পেয়ারা, লেবু, কলা, সফেদা, জাম্বুরা,জামরুল প্রভৃতি ফলের বাগান রয়েছে। ফলনও ভাল। চায়না-১, চায়না-২ ও চায়না-৩ জাতের লিচু অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু। আনারসের মধ্যে হানিকুইন, ক্যালাঙ্গা ভালো জাতের। দেখতে চমৎকার খেতেও সুস্বাদু। আম্রপালি তো ল্যাংড়া আমকেও হার মানিয়েছে।
সমস্যার আছে আরও ধরন, বাগানে এক সঙ্গে ফল ফলারি পাকা শুরু হয়। পাকা ফল আহরণ খুবই কষ্টকর । অনেক সময় গাছেই পচে নষ্ট হয়। সংরক্ষণ করা গেলে না হয় আহরণে আগ্রহ পেতো। দু-চার পয়সা না পেলে পন্ড শ্রমে লাভ কী ? এই রকম ধারণাই কৃষকদের। পাহাড়ের ফল দিয়ে জেম, জেলি, জুস ও বিভিন্ন প্রকার আচারের কারখানা করা যায়। এলাকায় এই ধরণের কারখানা গড়ে উঠেনি। বিভিন্ন ফল ফলারি প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছরই সংরক্ষণ সম্ভব। এমনকি দেশিয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যেতো সংরক্ষিত ফলের রস।
বাংলাদেশের এক দশমাংশ অংশে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এই তিন জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রাম। দেশের অন্য এলাকা থেকে এ অঞ্চল অনুন্নত। অসংখ্য পাহাড়-উপত্যকা বেষ্টিত পার্বত্য এলাকায় আবাদযোগ্য মাঠ ফসলি জমির পরিমান খুবই কম। এখানে বসবাসরত দরিদ্র প্রান্তিক চাষীদের উদ্যান কৃষিতে সম্পৃক্ত করে জীবন মান উন্নয়নে
পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য জেলা পরিষদ সমন্বিত ও সর্বাত্মক ভাবে মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া। মিশ্র ফল চাষ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক হাজার কৃষক বিনামুল্যে ফল বাগান করার সুযোগ পান। ২০০৪ এ শুরু হয়ে এখন বিশাল মহীরুহের রুপ নিয়েছে এর পরিধি। উৎপাদন বেড়েছে হাজার গুন বেশি। সে তুলনায় সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনায় রয়ে গেছে বড় ধরনের ঘাটতি। যে কারণে প্রতিবছর এই সময় চাষীদের পড়তে হয় মারাত্বক বিড়ম্বনায়। উদ্দেশ্যই ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দেশিয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি এবং দরিদ্র মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। সেই সাথে সূষ্ঠুবাজার ব্যবস্থাপনার দিকটিও লক্ষ্য রাখা দরকার ছিল। কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কিংবা পার্বত্য জেলা পরিষদ উদ্যোগী হয়ে হিমাগার ও জেম,জেলির কারখানা গড়ায় দ্রুত হাত দিতে পারে। অতিরিক্ত টোল,চাঁদাবাজিসহ নানা অসঙ্গতি অনতিবিলম্বে দূরকরা উচিত। দোষীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। বাগান মালিক ও কৃষকদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর উল্লেখিত বহুমুখী প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে পাহাড়ি অর্থনীতিতে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সত্যিকারের সক্রিয়তাই আমাদের একান্ত চাওয়া।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।