আব্দুর রশিদ

বর্তমানে আমরা একটা দুঃসময় অতিক্রম করছি। নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার এমন কোনো দিক নেই, যেখানে আমরা চরম অধঃপতনের শিকার নই। খুন, গুম, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি এখন সমাজের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া লেগেছে।

অন্যের সফলতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই তো সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কারও বিপদে সাহায্য করি না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি।
অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অপদস্থ করা, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে নারীদের কটূক্তি করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মারামারি, খুন—কোনোটিই বাদ পড়ছে না। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে আমিই ভালো, আমিই সফল হব, সবকিছু আমারই হতে হবে, আমার থেকে অন্য কেউ ভালো থাকতে পারবে না, সেটা যেভাবেই হোক।

প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।

অপরাধ, অনৈতিকতা ও অসভ্যতার এমন নিত্যনতুন প্রকার ও ধরন প্রকাশিত হচ্ছে, যা ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষকে হতবাক করে দিচ্ছে। কোনো উদাহরণের প্রয়োজন নেই। কারণ এখন এক ঘটনার নির্মমতায় ভারাক্রান্ত সমাজের দীর্ঘশ্বাস না সরতেই তার চেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা আঘাত হানে মানুষের হৃদয়ে।

বর্বরতা ও অসভ্যতার ক্ষেত্রে আমরা জাহেলী যুগকে উপমা হিসাবে পেশ করি। বাস্তবেও তা উপমার যোগ্য। কিন্তু চরম বাস্তবতা হল অন্যায় ও অপরাধের অসংখ্য পথে বর্তমান সমাজ জাহেলী যুগকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে।

অর্থের প্রতি অতি লালসা এবং শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষ সব মানুষের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সামাজিক উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেয়া, বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্তি, রাষ্ট্রের উদাসীনতা ইত্যাদি।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ জিন, হিংস্র প্রাণী ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক ভয় পেত। তাই নির্জন পথে বা অন্ধকারে কোনো মানুষের উপস্থিতির আভাস পেলে নিরাপত্তাবোধ করতো, সাহস ও সান্ত্বনা পেত। কিন্তু এখন মানুষকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই এখন ভরদুপুরেও নির্জন পথে অপরিচিতি কাউকে দেখলে জানমাল হারাবার ভয়ে মানুষের বুক দুরুদুরু করে।

আরো ভাববার বিষয় হল, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ অন্যায়-আপরাধের মূল কারিগর বর্তমান সমাজের একশ্রেণির শিক্ষিত মানুষ। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনায় রেকর্ড করা, খুন, গুম, চাঁদাবাজি সবকিছুতেই আমাদের কিছু সংখ্যক শিক্ষিত লোকেরাই জড়িত। আজ শিক্ষিত মানুষের চেয়ে অশিক্ষিত মানুষের কাছেই সাধারণ মানুষের জীবন বেশি নিরাপদ। কিন্তু কেন? অতীতে আমাদের এত কিছু ছিল না, কিন্তু সমাজে শান্তি ছিল। মানুষগুলো মানুষ ছিল। আজ আমাদের এত কিছু আছে অথচ পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কোথাও শান্তি নেই।মানবিক মূল্যবোধ নেই।
তাহলে তখন এমন কী ছিল যা এখন নেই বা আগের মত নেই? তাই উভয় সময়ের চিত্র এত ভিন্ন! এত বিপরীত! কেন?

আমাদের দেশ ও সমাজ তত বেশি অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। এটা এক অনিবার্য পরিণতি। কারণ ইসলাম শুধু পরকালীন বিষয় নয়, পার্থিব জীবনের সুখ ও সাফল্যের একমাত্র পথও ইসলাম। ইসলামী জীবনের মূল শিক্ষা হল আল্লাহর ভয় এবং পরকালীন জবাবদিহিতা। আর এটাই একমাত্র উপাদান, যা মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। মানুষকে করতে পারে সহনশীল।পরহিতৈষী, সত্যিকারের সৃষ্টির সেরা জীব। যে শিক্ষা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতার বোধ সৃষ্টি করে না, সে শিক্ষা মানুষকে ব্যবহারিক জীবনে গতিশীল করতে পারে, করতে পারে উপার্জন ও ভোগবিলাসে উন্নত, কিন্তু সে শিক্ষা মানুষের অপরাধ-প্রবণতা দমাতে পারে না। তাকে সত্যিকারে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। যার বাস্তব চিত্র আমাদের আজকের সমাজ।

মূলত এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করাসহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয়, প্রতিরোধ করা আজ আমাদের সবার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।