ড. মুন্সী মুর্তজা আলী:
আমরা সবাই জানি বেলফোর ডিক্লারেশনের মাধ্যমে কেমন অন্যায় ও অবৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। জন্ম দেওয়া হয়েছিল এজন্য বললাম, কেননা পশ্চিমা বিশ্বের সরাসরি সহায়তায় নগ্নভাবে এর প্রতিষ্ঠা হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতে তারা প্রথমে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিল। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের প্রায় অধিকাংশ ভূমিই দখল করে নিয়েছে। গাজা ও পশ্চিম তীরে তারা দীর্ঘদিন ধরে কোনোরকমভাবে মাথা গোঁজার ঠায় নিয়ে অমানবিকভাবে জীবনযাপন করছে। ক্ষুধা, যুদ্ধ, ধ্বংস, মৃত্যু যেন তাদের নিত্যদিনের সাথী। মানবেতর জীবনযাপন করতে করতে মানবতা কি আজ তারা ভুলে গেছে? সম্প্রতি রোজার মধ্যে ইসরাইলি বাহিনী মসজিদুল আল আকসায় ঢুকে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা শুধু অমানবিকই নয়, অপরাধেরও শামিল। কিন্তু এ যুদ্ধাপরাধের বিচার কে করবে? তারা নারী ও শিশুহত্যা করেছে পরিকল্পিতভাবে। এর জবাবে হামাস ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের মতে, হামাস ইসরাইলে এ হামলা করে অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ ইসরাইলের বর্বরতা নিয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। সত্যি কী নির্দয় আচরণ!

খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেই ফেললেন, ‘ইসরাইলের নিজেদের প্রতিরক্ষার অধিকার আছে’। মিস্টার প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জি ঠিকই বলেছেন, ইসরাইলের নিজেদের প্রতিরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। ফিলিস্তিনিদের যে বেঁচে থাকার অধিকার আছে-এ কথাটি তো আপনি বললেন না? ইসরাইল নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য নারী ও শিশুহত্যা করে সারা ফিলিস্তিনজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে। অথচ তারা কোনো সন্ত্রাসী নয়? আর হামাস নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষায়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় রকেট ছুড়লেই ওরা সন্ত্রাসী? সত্যিই কী সহজ হিসাব! মিস্টার প্রেসিডেন্ট বাইডেন, আপনি এমন এক দেশের প্রেসিডেন্ট, যেখানে মানবাধিকার সুরক্ষিত, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত, নারী ও শিশু সুনিশ্চিত নিরাপত্তায় দিন অতিবাহিত করে। আপনি তো জনগণের সরকার। আপনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছেন। আপনি আমেরিকা ও পৃথিবীর অনেক ঘটনার সাক্ষী। একবার ভেবে দেখুন তো, ‘ইসরাইলের নিজেদের প্রতিরক্ষার অধিকার আছে’-এ কথায় মার্কিন জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে কি না? এ কথার বিশ্লেষণের বিচার আপনার বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলাম। নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করে দেখুন, আপনার উক্তিটি মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেছে। এতে আমেরিকার সব মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। আমেরিকার জনগণ আপনার কাছ থেকে যেমন এমন বক্তব্য আশা করে না, তেমনই বিশ্ববাসীও আপনার কাছ থকে এমন বক্তব্য আশা করে না। কারণ, আপনি তো শুধু আমেরিকার জনগণের নেতা নন। আপনি বিশ্বনেতা। আপনি ট্রাম্পকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছেন। আমেরিকার জনগণ ও বিশ্ববাসী নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে ট্রাম্পের মতো আচরণ আশা করে না। বিশ্বনেতাদের বলছি, আপনাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে জনগণের কাঠগড়ায় না দাঁড়ালেও বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আপনারা প্রশ্ন করুন, আপনারা অপরাধ করছেন নাকি ঠিক করছেন?

এবার আসি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে। বিশ্বের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আমেরিকা বিশ্বের একচ্ছত্র পরাশক্তি এবং এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে ইসরাইল রাষ্ট্রটি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি আজ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, ইসরাইল ছাড়া বুঝি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ। মধ্যপ্রাচ্যে এক ইসরাইল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্রের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। যদিও বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শক্তিশালী দেশ যেমন সৌদি আরব, আরব আমিরাত আমেরিকা ও ইসরাইলের কবজায় চলে গিয়েছে।

একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি এমন কোনো বিধান বা সংবিধান নয় যে, সেটি পরিবর্তন করা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এ একপেশে পররাষ্ট্রনীতির ফলে ইসরাইল তার ফায়দা লুটছে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নীতিতেও আইপ্যাক (ইসরাইল আমেরিকান পাবলিক অ্যাফেয়ারস কমিটি, যারা আমেরিকায় ইসরাইলিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করে মার্কিন সরকারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে) আমেরিকাকে এমনভাবে জাপটে ধরেছে, আমেরিকা যেন এর থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। এমনকি মার্কিন সরকারকে বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে, আমেরিকায় যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আই প্যাকের কারণে আমেরিকার ঘাড়ে বন্দুক রেখে ফায়ার করছে ইসরাইল। আর সেই দোষের ভাগীদার হচ্ছে আমেরিকা। ইসরাইলের প্রতি আমেরিকার এ অন্ধ সমর্থনের ফলে সুদূর ভবিষ্যতে আমেরিকারই ক্ষতি হবে বলে অনুমেয়। আরব লীগ এবং ওআইসি-এর কার্যক্রম পূর্বে থাকলেও বর্তমানে এসব সংস্থা কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এবার আসি জাতিসংঘের কথায়। আরব-ইসরাইল সংকটে জাতিসংঘ কী করেছে, আর কী করতে পারেনি সেই বিতর্কে না গিয়ে এখন সময় ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করা। আমরা যখন লেখা ও আলোচনায় ব্যস্ত, তার মধ্যে কত ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও জানমালের ক্ষতি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধবিরতি হয়েছে। এখনই সময় সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ ও শক্তিশালী দেশগুলোর এগিয়ে আসা। নইলে ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে ফিলিস্তিন জাতি ও রাষ্ট্র পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে আর বেশি দিন লাগবে না।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া