সিবিএন ডেস্ক:
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি বস্তিতে বসবাস করতেন মিনু। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। তাকে ছেড়ে গেছেন পঙ্গু রিকশাচালক স্বামী। বাবার বাড়িতেও তেমন কেউ নেই। একমাত্র ভাই মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিতেন এই অভাবী মহিলার।

মিনুর বড় ছেলে একটি মুদি দোকানের কর্মচারী, মেজোটা চায়ের দোকানে কাজ করত ফুটফরমেয়াশির। অভাব লেগেই থাকতো তার পরিবারে। ছোট মেয়েটার পাঁচ বছর বয়সে মারা গেছে।

অভাবের তাড়নায় জেল-জুলুমকে পাত্তা না দিয়েই গিয়েছিলেন কারাগারে। হত্যা মামলার আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমি প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন সহজেই। কিছু চাল-ডালের লোভে অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ ও সহজ প্রকৃতির মিনু বিচারকের কাছে গিয়ে হাত তুলেছিলেন নির্ভয়ে। মিনুর এই সরলতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে লাপাত্তা খুনের মামলার আসামি কুলসুমি আক্তার কুলসুম।

মিনু সম্পর্কে এমনটাই বলছিলেন তার আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ। ঘটনার মূল বিষয়বস্তু আলোচনায় আসে মিনুর শিশু মেয়ে জান্নাতকে কেন্দ্র করে। আড়াই বছরের জান্নাতকে ঘরে রেখেই কারাগারে গিয়েছিলেন মিনু। উপায়ান্তর না দেখে এতিমখানায় ভর্তি করানো হয় মিনুর মেয়ে জান্নাতকে।

কারাগারে যাওয়ার পর শিশু জান্নাতের খরচ চালাতে না পেরে এতিমখানা থেকে পড়া বাদ দিতে হয়। ছোট শিশু জান্নাতকে নিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন প্রতিবেশী একজন। ওই বাসায় জান্নাত অন্য শিশুদের সঙ্গে থাকত।

করোনাকালে একদিন মিনুর মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় আইনজীবী মুরাদের। তিনি তার পরিচয় জানতে চাইলে শিশুটি বলে আমার মা কারাগারে। কিন্তু কেন? এরপর বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের কারাপরিদর্শক নথি ঘাঁটাঘাটি করে দেখেন কুলসুমির পরিবর্তে জেল খাটছেন মিনু। কারাগারে রাখা বালাম বইসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে এমনটাই পাওয়া যায়। এরপর চট্টগ্রামের আদালতের হস্তক্ষেপে ধাপে ধাপে বের হয় মিনুর কারাগারে যাওয়ার বিষয়।

পরে এ মামলার উপনথি বিশেষ বাহকের মাধ্যমে পাঠানো হয় হাইকোর্টে। কয়েকদফা শুনানি শেষে গত ৭ জুন মিনুকে কারামুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে আদেশের কপি চট্টগ্রামের আদালতে পৌঁছানোর পর বুধবার (১৬ জুন) মিনু কারামুক্ত হন। কারামুক্ত হয়ে চলে যান আরফিন নগর ছিন্নমূল বস্তিতে। মিনু কারামুক্ত হলেও তার রেখে যাওয়া শিশু জান্নাত মারা গেছে বলে জানিয়েছে আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ।

মিনু যেভাবে হলেন ‘কুলসুম’
জানা যায়, ২০০৬ সালের ৯ জুলাই মুঠোফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর ওই ঘটনায় কারাগারে পাঠানো হয় কুলসুমিকে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) আদালত থেকে ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমি।

ওই মামলার রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর। রায়ে কুলসুমিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমী সেজে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান মিনু আক্তার। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারিক আদালতের সাজার বিরুদ্ধে কুলসুমি হিসেবে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। এই আপিল আজ হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে।

মামলার নথি পর্যালোচনায় কারাগারের মহিলা ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময় কুলসুমির বদলে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এরপর রেজিস্ট্রারের ছায়ালিপিসহ গত ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আদালতে একটি আবেদন দেন চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার (চলতি দায়িত্ব) মো. শফিকুল ইসলাম খান। পরদিন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ (চতুর্থ আদালত) শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে মিনুকে হাজির করা হয়।

সেদিনই মিনুর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন বিচারক। মিনুর বক্তব্য অনুযায়ী মর্জিনা নামের এক নারী তিন বছর আগে ডাল-চাল দেবেন বলে তাকে ঘর থেকে নিয়ে এসে জেলে ঢুকিয়ে দেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের বস্তিঘরে ছিলেন। তার স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। মর্জিনা বলেছিলেন, রোজার পর তাকে জেল থেকে বের করবেন। তিনি এখন বের হতে চান। কুলসুমিকে তিনি চেনেন না।

এরপর চট্টগ্রামের আদালত মূল রেজিস্ট্রারটি আদালতে দাখিল করতে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপারকে নির্দেশ দেন। রেজিস্ট্রারে থাকা আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমির ছবির সঙ্গে মিনুর ছবির অমিল পাওয়া যায়।

এরপর গত ২৩ মার্চ চট্টগ্রামের আদালত জরুরি ভিত্তিতে ওই উপনথি হাইকোর্টে পাঠাতে আদেশ দেন। এরপর চলতি বছরের ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায় মিনুর উপনথি। শুনানির সময় হাইকোর্ট এ মামলার বিষয়ে গুরুত্ব কিছু মন্তব্য করেন।

‘অর্থের বিনিময়ে নির্দোষ ব্যক্তিকে কারাগারে রাখা দুর্ভাগ্যজনক’
প্রকৃত আসামিকে বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে নির্দোষ ব্যক্তিকে কারাগারে রাখা দুর্ভাগ্যজনক (আনফরচুনেট) বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। গত ৬ জুন মিনুর বদলি সাজা খাটার বিষয়ে শুনানির সময় এমন মন্তব্য করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

শুনানির সময় মিনুর আইনজীবী মোহাম্মাদ শিশির মনির আদালতে বলেন, ‘মাই লর্ড! সারাদেশে এরকম ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। এসব তথ্য আমার কাছে আছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই মন্তব্য করেন।

‘মিনুর ঘটনা ক্রিমিনাল জাস্টিসের ওপর প্রতারণা’
গত ৭ জুন বদলি সাজা ভোগকারী মিনু বেগমের ঘটনা ক্রিমিনাল জাস্টিসের ওপর প্রতারণা বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। শুনানির সময় মিনুর আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির আদালতে বলেন, ‘মামলার শুনানির সময় আদালত মন্তব্য করেছেন এটি একটি আনফরচুনেট ঘটনা। ক্রিমিনাল জাস্টিসের ওপর একটি প্রতারণা। এটা একটা ফ্রড। এই ফ্রডের রুট খুঁজে বের করতে হবে। রুট খুঁজে বের করতে ইনভেস্টিগেশন করতে বলা হয়েছে। এটাই বাকি পদ্ধতি।’

মিনুকে মুক্তির নির্দেশ হাইকোর্টের
শুনানি শেষে আদালত তার আদেশে ‘প্রথম অর্ডারে মিনুকে মুক্তি দিতে বলেছেন। দ্বিতীয়টিতে কুলসুমকে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। তৃতীয়টিতে তিন আইনজীবীসহ চারজনকে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত আকারে ব্যাখা দিতে বলা হয়েছে।

এদের মধ্যে তিনজন আইনজীবী, অন্যজন আইনজীবী সহকারী। আগামী ২৮ জুন লিখিত আকারে এ তিনজনকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখা দিতে বলা হয়েছে।

সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যখা দেবেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু আদালত-২ এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এমএ নাসের, আইনজীবী বিবেকানন্দ ও নুরুল আনোয়ারসহ চারজন।

আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মাদ শিশির মনির। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. বশির উল্লাহ। কুমসুমের আইনজীবী ছিলেন ইকবাল হোসেন।

ইকবাল হোসেনের কাছে আদালত জানতে চান মামলার প্রয়োজনীয় নথিপত্র কে আপনাকে সরবরাহ করেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের নারী শিশু আদালত-২ এর পিপি এমএ নাসেরসহ চারজন। তখন চারজনের নাম আদালতে উপস্থাপন করা হয়। -ঢাকাটাইমস