সিবিএন ডেস্ক:
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলায় ভারত থেকে কেনা কোভিশিল্ড টিকা কেনার চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশলা বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন মঙ্গলবার (৮ জুন) এ বিষয়টি তুলে ধরে।

এ নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গবেষণায় আমরা কিছু ইতিবাচক দিক পেয়েছি, যা আশাব্যঞ্জক। তবে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলাফল আমরা এখন ভোগ করছি। একক উৎস থেকে টিকা আনার উদ্যোগ নেওয়াটাও উচিত হয়নি।

এছাড়া টিকা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও ঘাটতি ছিল। ঝূঁকিপূর্ণ মানুষদের অনেকেই টিকা কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছেন। প্রতিকূল অবস্থার কারণেও অনেকে বঞ্চিত হয়েছে।

গবেষণা পত্রটি জুম প্ল্যাটফরমে উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক জুলকার নাইন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যেকার টিকা ক্রয় চুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট। এক্ষেত্রে চুক্তির ধরন, চুক্তির শর্তাবলী, ক্রয় পদ্ধতি, অগ্রিম প্রদান, তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা, তাদের অন্তর্ভুক্তির কারণ ও তারা কিসের ভিত্তিতে কত টাকা কমিশন পাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া ক্রয় চুক্তি নিয়ে কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান ছিল বিস্ময়কর।

সরকারি ক্রয়ে আইন অনুসরণে ঘাটতি: কোভিড-১৯ টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধি অনুসরণ করা হয়নি। টিকা ক্রয় পরিকল্পনা ও চুক্তি সম্পাদন নোটিশ সিপিটিউ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি এবং একটি উৎস থেকে ক্রয়ের ক্ষেত্রে দর-কষাকষির নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি, আর এই সবই সরকারি ক্রয় বিধি, ২০০৮ এর ১৬ (১১), ৩৭ (১), ১২৬ (৩), ৭৫ (৩) বিধির লঙ্ঘন।

যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২.১৯ ডলার), ভারত (২.৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) এবং নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। খরচ বাদে তৃতীয় পক্ষের প্রতি ডোজ টিকায় প্রায় ৭৭ টাকা করে মুনাফা হিসেবে প্রথম ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহে ৩৮.৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।

এভাবে তিন কোটি ডোজে তাদের মোট লাভ হবে ২৩১ কোটি টাকা। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচতো তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন নেপালে সরাসরি এবং শ্রীলংকায় সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনের মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ক্রয় করা হচ্ছে। তবে চীনের সঙ্গে সরকার সরাসরি ক্রয়-চুক্তি করেছে, এই চুক্তি অনুযায়ী চীনের টিকা বাংলাদেশ ১০ ডলার দিয়ে কিনছে যা বিশ্ব বাজারদরের (১০-১৯ ডলার) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাশিয়া থেকে টিকা কেনার আগে চুক্তির বিভিন্ন শর্ত পর্যালোচনা করা হলেও সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের পর্যালোচনা ও দর-কষাকষি লক্ষ্য করা যায়নি। ক্রয় বিধি ২০০৮, এর ৩৮ (৪) (গ) আনুসারে চুক্তির প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিরোধ বা দাবি নিষ্পত্তি পদ্ধতির ব্যবস্থাপনা ক্রয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব পক্ষকে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, যা আইনের লঙ্ঘন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অনুচ্ছেদ ১২ (কে) অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কেউ সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবে না।

জাতীয় কমিটি এবং বিএমআরসি একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ সাড়া না দেওয়ায় ট্রায়াল প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে বিকল্প উৎস না থাকার কারণে আকস্মিকভাবে চলমান টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩.৮ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা ও সে অনুযায়ী টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায় ঘাটতি লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন পেশা/জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি, তাদের টিকার আওতায় নিয়ে আসার প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় নিরূপণ না করার কারণে টিকা বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণা, টিকা গ্রহণে ভীতি ও অনাগ্রহ ছিল। কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি টিকার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। অনলাইনভিত্তিক নিবন্ধন হওয়ার ফলে টিকা প্রদান প্রক্রিয়াটি সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর অনুকূলে। ইন্টারনেট না থাকা ও কারিগরি জটিলতায় সাধারণ জনগণের বড় অংশই নিবন্ধন করতে পারেনি।

একইসঙ্গে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে প্রবাসী যাত্রীদের ব্যাপক দুর্ভোগ ও কর্মক্ষেত্রে ফিরতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, এবং টিকা সনদ না থাকায় প্রত্যেকের গড়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়।

এছাড়া কোনো পেশা/জনগোষ্ঠীর সব সদস্যকেই পরিপূর্ণভাবে টিকার আওতায় আনা হয়নি। বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রচারে ঘাটতি, নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল ও তাদের অনুকূলে না থাকায় নাগরিক নিবন্ধনের আওতায় স্বল্প আয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির হার খুবই কম দেখা গেছে। টিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের হার ছিল ৩৭ শতাংশ।

অধিকাংশ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে ৩য়-৪র্থ শ্রেণির কর্মী (৫৬ শতাংশ), পরিচ্ছন্নতা কর্মী (২৬.৬ শতাংশ), মাঠপর্যায়ের কর্মীদের টিকার আওতায় আসেনি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে টিকা গ্রহণে অনাগ্রহ বা ভীতির কারণে (৬১.৬ শতাংশ) এবং ৪০ বছরের কম বয়স থাকার (৫১.৬ শতাংশ) কারণে কর্মীরা টিকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকছে বলে দেখা যায়, এবং অনাগ্রহ বা ভীতি দূর করতে উদ্যোগেরও ঘাটতি রয়েছে।

৯.১ শতাংশ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকর্মীদের নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি; বাকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মীদের শুধুমাত্র মৌখিকভাবে নির্দেশ প্রদান (৬৮.১ শতাংশ) করেছে।

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারসহ মাঠপর্যায়ের বিদ্যমান কর্মী/অবকাঠামো ব্যবহার করে নিবন্ধনের সুবিধা না থাকায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জনসংখ্যার বড় একটা অংশ নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় নিবন্ধন করতে ৫-১০ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও কিছু পেশা/জনগোষ্ঠীর মানুষের বয়স ৪০ বছর না হওয়ার কারণে তারা নিবন্ধন করতে পারেনি। বয়সসীমার কারণে ও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় অনেক প্রবাসীদের বিদেশ ফেরত যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।