শামীম আকতার

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে যে সব বিষয়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, সামাজিক উন্নয়ন সূচকে সমৃদ্ধশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে তার অন্যতম অনুঘটক নারী উন্নয়ন। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ণ, অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনয়ন, রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়া, ক্রীড়াঙ্গনে সফলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নারীর উন্নয়ন দেশ ও সমাজ উন্নয়নের সমার্থক। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ পারিবারিক এবং সামাজিক কল্যাণ্যের জন্যই জরুরী। ড. আতিউর রহমানের ভাষায় বলি “টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতির মূলস্রোতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই জরুরী “।
বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্টানে, অফিস আদালতে,কল কারখানায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উল্লেখযোগ্য নারী নিয়োজিত রয়েছেন।২০১৯ সালের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, দেশে ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লক্ষ নারী।প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক পদে ১৪ শতাংশ, উর্ধতন কর্মকর্তা পদে ৬ শতাংশ । ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ১৬৬৯৭ জন প্রায়। রপ্তানিখাতের অন্যতম মাধ্যম পোশাক শিল্পে কর্মরত ১৪ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশ এবং চা শ্রমিকের ৫২ শতাংশ নারী।
পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নকল্পে কর্মক্ষেত্রে নারীরা অবদান রেখে যাচ্ছেন কিন্তু তার কর্মপরিবেশ আজও উপেক্ষিত। অনেক বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে এগিয়ে গেলেও সম্মূখিন হতে হয় নানা সমস্যার। অবমূল্যায়ন, কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া, প্রমোশন ও বেতন বৈষম্য, অসৌজন্যমূলক আচরণ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, শারিরীক মানসিক নির্যাতন, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি। তবে আজকে যে বিষয়টি নিয়ে বলতে চাই তা হলো নারীর কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার।
বাস্তবতার নিরিখে এবং প্রয়োজনের তাগিদে নারীদের ঘরের বাইরে অবস্থান, যাতায়ত, ভ্রমণ আবশ্যিক। জৈবিক কারণে তাদেরও প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয়। ওয়াক্তমতো সালাত আদায় করতে হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্টান, ব্যাংক বীমা, ব্যবসা প্রতিষ্টান, বাস, রেল স্টেশন, লঞ্চ, ফেরিঘাট, কারখানা, অবকাঠামো নির্মাণ স্থল সহ প্রায় প্রতিটি স্থানে শৌচাগারের প্রচলিত যে ব্যবস্থা তা কি নারীদের ব্যবহার উপযোগি বা স্বাস্থ্যসম্মত? একজন পুরুষ যে পরিবেশে প্রাকৃতিক কাজ সারতে পারেন বা পশ্রাব পায়খানা করতে পারেন, ওজু, সালাত আদায় করতে পারেন নারীর জন্যে তা কতোটুকু সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের মতে, গণ শৌচাগারে পুরুষের চেয়ে নারীদের নানাভাবে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা অনেক বেশি। অথচ নারীর এ অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনটি নিয়ে কখনো কেউ ভাবেনা, গুরুত্ব দেয়না।
দাতা সংস্থারা বেশ ক’বছর আগে থেকেই নির্দেশনা দিয়ে আসছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের আলাদা বসার স্থান, ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখতে। এমনকি বাস টার্মিনাল, লঞ্চ স্টেশন, ফেরিঘাট, অবকাঠামো নির্মাণস্থলের কথাও উল্লেখ রয়েছে।সরকারের সিদ্ধান্তও তাই। কিন্তু নারীদের আলাদা টয়লেট বা শৌচাগার ব্যবস্থা করার বিষয়টা কোনো কর্তৃপক্ষ ভাবেনা গুরুত্ব দেয়না।
কক্সবাজারের কথাই বলি, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত ভবন, সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্টান, উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্টান, ব্যাংক,বীমা কোথাও নারী শৌচাগার নেই। কলেজের নারী শিক্ষক, সিনিয়র নারী আইনজীবি, উন্নয়নকর্মী অনেকের সাথে কথা বললাম সবাই ভুক্তভোগী। লজ্জায়, সংকোচে অবর্ণনীয় কষ্ট নিরবে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, বীচ পাবলিক টয়লেট সহ স্বল্পসংখ্যক স্থানে আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।
এবার আসি আমার বাস্তব জীবনের কথায়। আমি বিনয়ের সাথে বলছি কারো উপর দোষ চাপানোর জন্যে লেখাটি নয়, বরঞ্চ সব কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতাটা তুলে ধরা এবং কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগী হওয়াই আমার অভিপ্সা। আমি একটি স্বায়ত্বশাসিত সেবা প্রতিষ্টানে চাকুরী করি ১৯৯৪ সাল থেকে। তখন অফিস ও মাঠ পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা কর্মচারী ৪ জন। পরবর্তীতে আরও যুক্ত হয় ১৩ জন। কর্মরত নারীর সংখ্যা কম বলে ২০১১ সাল পর্যন্ত শৌচাগার আলাদা করার প্রসংগে কথা বলার পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল না। ২০১২ সালে দাতা সংস্থার “জেন্ডার এ্যাকশন প্লান” বিষয়ে যখন ধারণা পাই তখন এ বিষয়ে কথা বলার একটি ভিত্তি তৈরি হয়। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে যারা ছিলেন তাদের সহযোগিতায় নারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং নারী সেবা গ্রহিতাদের সুবিধার্থে আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করি এবং লিখেও দিই ” নারী টয়লেট”। বিধি বাম, ব্যবস্থা করতে না করতে পুুরুষ সহকর্মীরা বিকল্প চাবিটা নিয়ে নিলেন, সৌজন্যতার খাতিরে কিছুই বলা গেলো না। তারা একবারও অনুধাবন করলেন না কেন নারী টয়লেট লেখা। বার বার তালা বদলাতে থাকলাম, পরবর্তীতে দেখি কে বা কারা তালা আর রাখে না।অফিসে আগত সাধারণ জনগণের ব্যবহারে আবারও হয়ে গেলো ব্যবহার অনুপযোগী, অস্বাস্থ্যকর। আমাদের কার্যালয়ে কমন বাথরুম অনেক কিন্তু সাধারণ জনগণ এবং বেশি সংখ্যক কর্মচারীর ব্যবহারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রায় অসম্ভব। এটাচ বাথরুম মাত্র কয়জন পুরুষ কর্মকর্তার কক্ষে যেখানে লোক সমাগম বেশি। অসংখ্য পুরুষের সামনে এ সব কক্ষে বাথরুমে যাওয়া আমার কাছে খুব অশোভনীয় মনে হয়।লজ্জায়, সংকোচে দিনের পর দিন পর্যাপ্ত পানি না খেয়ে থেকেছি, প্রাকৃতিক প্রয়োজন বন্ধ করে রেখেছি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে।
বিগত ২০২০ সালের আগস্ট হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমি প্রায়ই অসুস্থ। এরিমধ্যে আমার ৫ বার ইউরিন ইনফেকশন হয়। কিডনি প্রায় আক্রান্তের দিকে। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হতে পারছিনা। ক’দিন পরপর পুনরায় ইনফেকশন। এটি দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছরের চাকুরীকালিন সময়ের সঞ্চিত সমস্যা। একদিনের নয়! অসুস্থতার কারণে চাকুরী করার মানসিকতাও হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইতোমধ্যে বাথরুম সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এ সমস্যা শুধুই কর্মক্ষেত্রে নয় গণ পরিবহনে, বাস স্টপে, রেল স্টেশনে আরও শোচনীয়। কথাগুলো আমি আমার জন্যে নয় বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত সকল মা বোনদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনার সুবিধার্থে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে যারা রয়েছেন তাদের উদ্দ্যশ্যে তুলে ধরা।
বিভিন্ন সেক্টরে নারীর ক্ষমতায়ণ হয়েছে কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মূলকেন্দ্রে নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে আমরা এখনো পৌছাতে পারিনি। পুরুষের সহযোগিতা, আন্তরিকতা, দায়িত্ববোধ খুব জরুরি। উপেক্ষিত এ সব বিষয় নিয়ে ভাবুন, মানবিক হউন এবং দায়িত্ব নিয়ে সমস্যার উত্তরণে এগিয়ে আসুন।সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেমন জরুরি তেমনি জরুরি তার গুণগত উন্নয়ন। অন্যতায় নারীর পক্ষে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন এবং পরিবার, সমাজ ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা অসম্ভ হয়ে উঠবে। কথায় আছে যতই এগুবে মানবী ততই এগুবে পৃথিবী।