এডভোকেট মোঃ আবদূর রহিম

বাবা আজ সেই দিন, যে দিন তুমি মহা অভিমানে চলে গেলে অচেনা এক অন্যলোকে। মনের কল্পনারা আজও তোমাকে ভুলতে দেয়না, আবার তোমার অস্তিত্বরা আমাকে তাড়া করে প্রতিক্ষণে। তোমার নিদারুণ শুন্যতা আমার হৃদয় বিষাদমলিন করে বুকের পাজর ভেঙ্গে তছনছ করে। তোমার বিয়োগ যাতনা ও হৃদয়ের আকুলতা কাউকে প্রকাশ করতে পারিনা বাবা । নীরবে-আড়ালে ও গভীর রজনীতে চোখের জলটুকুই যেন সঙ্গী হয়ে আছে আজও।

তোমাকে ভাবতেই চোখের জলের দেখা মেলে বার বার, যেন তোমার সাথে তাদের সখ্যতা আছে, তাই চোখের জলকেই এখন সঙ্গী ভাবি। বাবা আজ তুমিহীন কষ্টের প্রহরগুলো বুকের ভিতর জমাট কান্নার ঢেউ তুলে যায় বার বার! তোমার নির্মোহ আদরের সেই নিখুঁত সুরের দেখা আজও আর মেলেনি কোথাও। বাবা কষ্টের ঢেউ গুলি রোজ হৃদয়ের মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে আর বারং বারং বলছে তোমার মাঝে আমার সমস্ত সুখ লুকিয়ে ছিল। বাবা তুমি যে এক বিশাল বটবৃক্ষ ও মাথার উপর মজবুত ছাদ তা আজ তিলে তিলে বাস্তবতা আমাকে প্রতি মুহূর্তে শেখাচ্ছে। পৃথিবীর সকল যন্ত্রণার কষ্টময় তীরের আঘাত নিজের গায়ে মেখে আর প্রচন্ড রৌদ্দুরের খরতাপে পুড়ে নিজের শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে তোমার বুকের ছায়ায় আগলে রেখেছিলে জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে।
বড় অসময় চলে গেলে বাবা। আমাদের জীবনের স্মৃতিটুকু তোমাকে প্রচন্ড বিমোহিত ও আপ্লুত করে তুলতো সেই দৃশ্যগুলো তোমাকে দেখাতে ব্যার্থ হলাম বাবা। জীবন নামক পাঠশালায় তুমি এক মহাজ্ঞানী আমার কাছে। তোমার হাত ধরেই শিখেছি সত্য-মিথ্যা ও সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য। তুমি বলতে আমি যে হাড়ভাঙ্গা কর্মের সাথে আছি জীবনে তোমাদের এ পথের পথিক আমি হতে দেবনা। বাবা তোমার সেই চাওয়া পূর্ণ হয়েছে কিন্তু এক অজানা নির্মম প্রলেপ সবকিছু ঢেকে দিয়েছে।

তোমার পবিত্র হাতের উপর শেষ নি:শ্বাসটুকু গ্রহণ করার পরম সৌভাগ্য হয়েছিলো মায়ের। তুমি চলে গেলে অজানা এক ঠিকানায়। একাকীত্ব এখনো, মানতে পারেনি, তাই বড় অবেলায় তোমাকে আমাদের কাছ থেকে ডেকে নিল। তোমার নীরেট ভালোবাসার স্মৃতিগুলো ঘিরে রেখেছে আজ আমাকে। দিন দিন তোমার স্মৃতির ডায়েরীগুলি ভারী হয়ে যাচ্ছে, বহণ করতে আমি যে আজ বড় ক্লান্ত বাবা, তবুও তোমার সব স্মৃতি বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই।

এক কাকডাকা সকালে হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে তোমার আদরের বৌমার দৃষ্টি পড়তেই সে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলো একজন সত্যিকারের পিতার সন্তানের জন্য কতটা ভালোবাসা। সেই ছোট বেলায় তুলতুলে মুখে ভালোবাসার পরশ মাখিয়ে দিয়েছো যেভাবে বার বার। হয়ত আমি বাবা হওয়ার পরেও তুমি তা ভুলতে পারোনি। আমাকে সেভাবে আদর করার প্রচন্ড ব্যাকুলতা ছিলো তোমার মনে। তাই খুব সকালে আমি যখন আমার কলিজার টুকরো সন্তানকে নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলাম ঠিক তখনি তুমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদর করেছো অনবরত। পৃথিবীতে বোধ হয় এটিই সেরা দৃশ্য যা তোমার আদরের বৌমা (যাকে তুমি মা বলে ডাকতে) নিজ চোখে মনের ক্যামেরায় ধারণ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে তোমার এ নি:স্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ আমার সন্তানের সামনে তুলে ধরে, যেন সে তোমার রেখে যাওয়া এ সুন্দরকে ধারণ করতে পারে তার বুকে। বাবা সে দিনের তোমার আদর আমি বুঝতে পারেনি, ঘুমের নিমগ্নতা আমাকে এতটাই ছুয়ে ছিলো যে আমাকে বুঝতে দেয়নি, আর সেই সুযোগে তুমি তোমার আদরের ছোয়া আমার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছো। তোমার আদর আমি তিলে তিলে অনুভব করি বাবা।
কোন কিছুতে অভিমান করে গো-ধরে বসে থাকতাম, খাবারের ওয়াক্ত যখন পেরিয়ে যেতো তখন তুমি বুঝতে তোমার আদরের সন্তানকে কিভাবে ভাতের প্লেটের কাছে বসাতে হয়। তুমি বলতে বাবা রাগ করতে নেই ভাত খেয়ে নাও, তুমি কথা না শুনলে তোমার ছোট ভাই-বোনও শুনবে না” তারপরও গো-ধরা থেকে যখন সরে আসতাম না তখন স্বভাব সূলভভাবে তুমি বলতে “ওরে আব্বা ওঠো না কেন, খেয়ে নাও, যাও যাও, পাগল কোথাকার, এমন করে ভ‍ালো ছেলেরা” এমন কথার পরে আমি অভিমান ভেঙ্গে খেয়ে নিতাম। কখনো কখনো খাওয়ার সময় তুমি পিঠে হাত বুলিয়ে শিক্ষা মূলক জ্ঞান আমার কর্ণকুহরে পৌছে দিতে। তোমার মতো শিক্ষক আমি আর পাইনি বাবা, তুমি সত্যিকারে আমার কাছে মহাজ্ঞানী ও মহা শিক্ষক। বাবা মনে আছে কি ? কিশোর বয়সেও তোমার কাছে ঘুমানোর সুযোগ গ্রহণ করেছি বার বার। আর একটি বিষয় আজও মন থেকে ভুলতে পারিনি বাবা সেটি হলো তোমার শরীর থেকে একটা ঘ্রাণ আসতো, খুব মিস করি বাবা তোমার সেই গায়ের ঘ্রাণকে।

তোমার মন তোমাকে বুঝিয়েছে তোমার ছেলে শনিবারেও আসবে না তাই প্রচন্ড অসুস্থ শরীরে জীবনের শেষ দৃশ্যে তুমি ভালোবাসার অনন্য উদাহারণ সৃষ্টি করতে নিজে চলে এলে আমাকে দেখতে ককসবাজারের বাসায়। ভেবেছো ছোট বেলার সেই ‍অভিমান আজও বুঝি আমি করি তাই অভিমান ভাঙ্গাতে চলে এলে বিস্মকরভাবে। উখিয়া সদরের মৌলভীপাড়া দূর থেকে তোমাকে দেখে হঠাৎ চোখের বারীর বাঁধ আমি সামলাতে ব্যর্থ বাবা। তুমি সুখে থেকো ওই পাড়ে।মহান আকাশ জমিনের মালিক মহান আল্লাহর কাছে এই আমার প্রার্থনা।তোমার ছেলে আজ অনেক খ্যাতি, সুনাম অর্জন করেছে আজ শুধুই তোমার দোয়াই।তবে বাবা না বলা এক যন্ত্রনা আজ আমাকে খুঁডে খুঁডে খাচ্ছে।তোমার দোয়ায় মহান রাব্বুল আলামিনের রহমতে এর পর ও আমি তোমার বৌ মা, আদরের নাতি নাতনীকে নিয়ে আমার বেহেস্ত আমার মাকে সাথে নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছি সুখময়। হে বাবা তুমি তো তুমিই, তোমার কোন উপমা নেই।বাবা আজকের এই দিনের ২০১১ সালে আমাকে এতিম ও অসহায় করে চলে গেলে ওই আকাশের নীল সীমানায়,যেখানে তোমাকে খুঁজে পাওয়ার সাধ্য আমার নাই। আজ আমি বড্ড বেশি খুঁজে বেড়ায়, যখন আমি আমার কর্মক্ষেত্রে সফলতা পাই। শুধুই তোমার দু পায়ে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করে বাবা তোমার ছোট্ট খোকা আজ নির্যাতিত নিপিড়ীত ও অ সহায় মানুষের কল্যাণার্থে এগিয়ে গিয়ে সফলতা অর্জন করেছে।বাবা আজ আর তোমাকে নিয়ে লেখার মত সে ভাষা আমার নেই। তোমাকে রহমানুর রাহেমীন পরপাড়ে ভাল রাখুক এই দোয়া। হে মাবুদ তুমি তো তুমি, তোমার দয়া ও মেহেরবানি ছাড়া তোমার সৃষ্টিকুলের কোন প্রাণীর বাঁচার উপায় নেই। তুমি আমার বাবার কবরকে বেহেস্তের নুর দিয়ে আলোকিত করে রাখিও। আমীন।

লেখক পরিচিতি : মরহুম মোহাম্মদ কালামিয়ার সুযোগ্য বড় সন্তান এড. মোহাম্মদ আবদুর রহিম, আইন উপদেষ্টা, একেনিউজবিডি২৪.কম ঢাকা, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), কক্সবাজার; সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সভাপতি, উখিয়া প্রেসক্লাব, কক্সবাজার।