মমতাজ উদ্দিন আহমদ:
দেশ-ধর্ম-মানুষের মঙ্গলে মগ্ন ছিল তাঁর চিন্তা ও কর্মধারা। মানুষ ও স্বধর্মপ্রীতির ফল্গুধারায় উদ্বেলিত হয়েছে তাঁর হৃদয়। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের অমীয় সুধা ছড়াতে গড়েছেন হাফেজখানা। এতিমদের আলোর দিশারি ছিলে তিনি। সৃষ্টি করে গেছেন তাই এতিমখানা। সর্বোপরি দ্বীনিশিক্ষার আলোর মশাল হাতে নিয়ে গড়েছেন মাদরাসা। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ মাদরাসা পরিচালকের পদ অলংকৃত করেছেন। মত ও পথের ভিন্নতায় কখনো নিজেকে জলাঞ্জলী দেননি। কোন সংকীর্ণতায় তাঁর মন আড়াল হয়নি। সদা অবিচল ছিলেন মানবিকতা ও ন্যায়ের পথে। তাঁর মাঝে ছিল না ভেদ-বুদ্ধির অন্ধকার। আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। সুবক্তা, দরাজদিল ও নীতিবোধের সাহসী প্রকাশ ছিল তাঁর মাঝে। তিনি বরেণ্য আলেম, অসংখ্য শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রূপকার ধর্মজ্ঞানশিক্ষানুরাগী আলীকদম ফয়জুল উলুম মাদরাসা ও হাফেজিয়া এতিমখানার পরিচালক মাওলানা শামশুল হুদা সিদ্দিকী।

‘সবার সঙ্গে মিত্রতা, নয় কারও প্রতি শত্রুতা’- এই ছিল তাঁর চিন্তাধারা। ধর্মীয় জ্ঞানে ভাস্বর ছিলেন তিনি। উন্মুক্ত ছিল তাঁর হৃদয়। হাসিমুখে সবার সাথে প্রীতিমধুর সম্ভাষণ ছিল তাঁর। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ তাঁর মাঝেও ছিল। তবে তাঁর পরিচালিত মাদরাসা, এতিমখানা ও হাফেজখানার উন্নয়নে তিনি ছিলেন দলীয়বৃত্তের রাজনীতি থেকে দূরে। কোন দল কিংবা অন্যকোন দল-মতের ওপর ছিল না প্রশ্নহীন আনুগত্য। তবে ইসলামী শিক্ষার সুমহান আদর্শের প্রচারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত ও অনলবর্ষী।

দেশ-জাতী ও ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনে উদ্যোগ ও উদ্যমে প্রাগ্রসর নেতৃত্বসুলভ আচরণ ছিল তাঁর মাঝে। তিনি আমৃত্যু ব্যাপৃত থেকেছেন ধর্মীয় শিক্ষার মশাল উড়াতে। তবে সংযত-সীমিত থেকেছেন নিজ পরিসরে। পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি ছিলেন আদর্শ স্বামী, পিতা ও অভিভাবক। তাঁর মাঝে ছিলো উদারনৈকি আত্মীয়তার বন্ধন। স্বার্থচিন্তা তাকে কখনো স্বীয় কর্মধারা থেকে বিচ্যুত করেনি। পারিবারিক ঐতিহ্যের মিথ্যে অহমিকায় তিনি কখনো বুঁদ হননি। আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-স্বজনের হঠকারিতা তাঁকে আহত করেছে বটে, তবে তিনি আদর্শ বিচ্যুত হননি। স্বার্থ লোলুপতায় নিজেকে বিসর্জন দেননি।

তিনি শিক্ষা জীবন শেষে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদ অলংকৃত করেছেন দীর্ঘ ২৪ বছর। প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি কঠোর হয়েছেন বটে। তবে তা ছিল প্রতিষ্ঠানের স্বার্থচিন্তায়। এটি কোনো ব্যক্তিস্বার্থের অবয়বে বিচার করা যায় না। তিনি কথা বলতেন অনলবর্ষীবক্তার ন্যায়। তাঁর ওয়াজে-বক্তব্যে সকলে হতেন মুগ্ধ শ্রোতা। বক্তব্যে নীতিবোধ, কুরআন এবং হাদিসের অমীয় কথামালার প্রকাশ ঘটাতেন। তাঁর কথায় ছিলো না কোন উগ্রতা। আদর্শ ও উদারনৈতিক নীতিবোধের সাহসী প্রকাশ ঘটতো তাঁর কথায়।

নিজের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে তিনি দুই যুগের ব্যবধানে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সাহায্য-সহযোগিতার আশায় তিনি ঘুরে ফিরেছেন দেশে-বিদেশে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এবং অন্যের কাছে হাত পেতেছেন এতিমদের প্রতিপালনে। কর্তব্যের আহ্বানে সাড়া দিতেন তিনি সবসময়। ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রচারক ও ধর্মীয় জ্ঞানের বাতিঘর ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘কিয়ামত পর্যন্ত দাওয়াত, তালিমে দ্বীনের কাজ আখেরি নবীর উম্মত তথা উম্মতে মুহাম্মদীকেই করে যেতে হবে।’ তাই তিনি দাওয়াতে তাবলিগের কাজেও সারাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

তিনি পার্বত্য জনপদ আলীকদম উপজেলায় সর্বজনপ্রিয় একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। যিনি শিক্ষাজীবন শেষ করার পর থেকেই মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। শুধু ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার করে নয়, নিজের শ্রম, আচরণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন একজন আদর্শ আলেমের নমুনা কী হতে পারে! তাঁর মাঝে ছিলো সততা, বাগ্মীতা, সাহস, সংযম ও অপরিসীম ধৈর্য্য ও শৃঙ্খলাবোধ। নিজ প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও পার্বত্যভূমি আলীকদমে একজন সজ্জন ও সুন্দর মনের মানুষ সর্বোপরি আলেম হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। নম্রতা, ভদ্রতা ও প্রাণোচ্ছ্বল সৌজন্যবোধ ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তাঁর মৃত্যুর পর সাবেক বর্তমান অনেক সরকারি কর্মকর্তাও তাঁর গুণাবলী ও বন্ধুবাৎসল্য নিয়ে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন। যা অনেকের জুটেনা!

মাওলানা শামশুল হুদা সিদ্দিকীর জন্ম জন্ম ১৯৬৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সে হিসেবে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৫৭ বছর। তাঁর জন্মস্থান চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বেতুয়া বাজার গ্রামে। পিতার কর্মসূত্রে তাঁর আলীকদম আসা। তাঁর পিতা ছিলেন নেতৃস্থানীয় মানুষ। ছিলেন আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য। মা গৃহিণী।

ছাত্রজীবনে শামশুল হুদা ছিলেন মেধাবী। তখন থেকে বাগ্মী হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। নামকাওয়াস্তা আলেম ছিলেন না তিনি। তিনি অন্তরের বিশ্বাস কাজে বাস্তবায়ন করতে কুরআন-সুন্নাহর নিরিখে। তাঁর কথায় ও কাজে মিল পাওয়া যায় আল্লামা ইকবালের সেই কবিতার চরণের-

“নহে সমাপ্ত কর্ম তোমার, অবসর কোথা বিশ্রামের? উজ্জ্বল হয়ে ফোটেনি আজও সুবিমল জ্যোতি তাওহীদের!”

নিজ এলাকার সমাজ ও মানুষের প্রতি মাওলানা শামশুল হুদার ছিল প্রগাঢ় দায়বোধ। আলেম সমাজের মাঝে অনুকরণীয় নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল তাঁর মাঝে।

১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীসে ডিগ্রী অর্জন করেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি আলীকদম উপজেলার রেপারপাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে সাড়ে সাতবছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে রেপারপাড়ি দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা। সেখানে তিনি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি তিনি তৎসময়ে রেপারপাড়ি পোস্ট অফিসে ‘পোস্ট মাস্টার’ হিসেবেও সরকারি দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৮ সালে তিনি পরিচালক পদে যোগ দেন আলীকদম ফয়জুল উলুম মাদরাসা ও হাফেজিয়া এতিমখানায়। সে সময় টিনের ছাউনী, গাছের খুুঁটি ও বাঁশের বেড়ায় জরাজীর্ণ ছিলো এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তিনি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সরকারি-বেসরকারি সাহায্যে এ প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। এনেছেন অবকাঠামোগত মানোন্নয়ন। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সকল আলেম সমাজের মাঝে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। দীর্ঘ ১০ বছর বান্দরবান জেলা ইমাম সমিতির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

সুদীর্ঘ ৩০ বছরের অধিককাল ইমাম-খতিব-শিক্ষকতা ও ধর্মীয় আলোচনায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন মাওলানা শামশুল হুদা সিদ্দিকী। আশির দশকে ‘আলীকদম’ মানোন্নীত থানা/উপজেলায় উন্নীত হওয়ার পর পার্বত্য এ জনপদে শিক্ষা-ধর্মীয় অঙ্গনে আলো ছড়াতে যে ক’জন পথিকৃৎ অবদান রেখেছেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন।

মাওলানা শামশুল হুদা সিদ্দিকীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আরো বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার অবকাশ রাখে। নিশ্চয় তাঁর শুভাকাঙ্খী, ছাত্র-শিক্ষকরা এ মহান মানুষটির জীবন ও কর্মকে আড়াল না করে তুলে ধরবেন সকলের মাঝে। পরিশেষে তাঁর অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বলতে চাই- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ মহান প্রভূর কাছে মরহুম মাওলানার জান্নাতের উচ্চতর স্থান আশা রাখি।

-মমতাজ উদ্দিন আহমদ
সাংবাদিক ও লেখক
সভাপতি, আলীদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা
মোবাইল: ০১৫৫৬৫৬০১২৬
তারিখ: ০২.০৬.২০২১ ইং।