জসিম উদ্দীন:

কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে সমুদ্র সৈকতে কিছুটা ঘোরাঘুরি করেন বা ছবি তোলেন। এজন্য ঘোড়ার মালিককে দিতে হয় ১০০ থেকে ৫০০ টাকা।

এই আয়ের উপর নির্ভর করে বেশিরভাগ ঘোড়ার মালিকই আয়েশি জীবনযাপন ও গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।

কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধের কারণে কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক নিষিদ্ধ থাকায় মালিকদের আয়-রোজগার করে দিতে পারছে না ঘোড়াগুলো। এ কারণে খাবার বন্ধ করে দিয়ে বেশিরভাগ ঘোড়া রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে মালিকরা। এতে করে অযত্ন, অবহেলায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ঘোড়া।

মালিক সমিতির দাবি, চলমান লকডাউনে ৬টি ও গত বছর লকডাউনে ২৪টিসহ মোট ৩০টি ঘোড়ার খাদ্যের অভাবে মৃত্যু হয়েছে। তবে ৩০টি ঘোড়া মারা গেলেও এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে দাবি করেছে প্রশাসন।

কিছু গণমাধ্যম ঘোড়ার মৃত্যু সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। যদিও ঘোড়ার মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

ঘোড়ার মালিকরা জানান, কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ৫৫টি ঘোড়া ব্যবহার হয়ে আসছে। একটি ঘোড়ার দাম ৩০ থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত। এসব ঘোড়া মালিকদের নিয়ে ২২ জন সদস্য বিশিষ্ট ‘কক্সবাজার ঘোড়া মালিক সমিতি’ নামের একটি সমিতি রয়েছে। সমিতির বাইরে আরও ১০টিসহ ৬৫টি ঘোড়া রয়েছে। এসব ঘোড়ার পিঠে চড়ে, ছবি তুলে নানাভাবে বিনোদন উপভোগ করেন পর্যটকরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সৈকতের পর্যটকদের বিনোদন দিয়ে প্রতি বছরের পর্যটন মৌসুমে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে একটি ঘোড়া দিয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত মালিকরা আয় করে থাকেন।

গড়ে ৩ হাজার টাকা হিসেব করা হলেও চার মাসে একটি ঘোড়া দিয়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করেন মালিকরা। বাকি মাসগুলোতে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ঘোড়া প্রতি আয় হয়ে থাকে।

সে হিসেবে একটি ঘোড়া বছরে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে সক্ষম। এর বাইরেও ঘোড়ার গাড়ি, বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসবে ঘোড়াগুলোর ব্যবহার হয়। যার বিনিময়ে ঘোড়া মালিকরা পান অর্থ।

ঘোড়ার মালিকদের তথ্যমতে, একটি ঘোড়ার খাবারের পেছনে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয়; সে হিসেবে বছরে ৭২ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যয় হয়ে থাকে।

কিন্তু চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণা করে সৈকতসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। যার কারণে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে কক্সবাজার। ফলে অন্যান্য পর্যটন ব্যবসায়ীদের মতো বেকায়দায় পড়েন ঘোড়া মালিকরা।

ঘোড়া মালিকদের দাবি, আয় বন্ধ হওয়ায় খাবার দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে ঘোড়া রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন।

অথচ ঘোড়ার আয়ের ওপরে নির্ভর করে আজ মালিকদের অনেকেই গাড়ি-বাড়ীর মালিক হয়েছেন। গড়েছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় ঘোড়ার মালিকই সচ্ছল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঘোড়ার মালিক বলেন, লকডাউনে খাদ্য না দিয়ে ঘোড়া রাস্তায় ছেড়ে দিলেও বেশ কয়েকজন ঘোড়ার মালিক আছে যারা, মাদক সেবন ও হোটেলে নারী এনে ফূর্তি করেন নিয়মিত। সারাদিন বাইক নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতেও তাদের দেখা যায়।

তার দাবি, হাতে-গোনা কয়েকজন ছাড়া সবারই ঘোড়ার খাবার দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। এরপরও মালিকরা ঘোড়ার প্রতি অমানবিক আচরণ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, করোনায় আয় বন্ধ থাকার অজুহাতে ঘোড়ার খাবার না দিলেও আইপিএলের ক্রিকেট নিয়ে জুয়ায় বাজি ধরে সমিতি পাড়ার দুইজন ঘোড়ার মালিক লাখ লাখ টাকা খুঁইয়েছেন।

ঘোড়ার মালিক সমিতির সভাপতি আসান উদ্দীন নিশান স্বীকার করেছেন ঘোড়ার আয় দিয়ে অনেকেই জায়াগা কিনে বাড়ি ঘর করেছেন, অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

আহাসান উদ্দীন নিশান বলেন, আমি নিজেও ঘোড়ার আয় দিয়ে সংসারের খরচ বহনের পাশাপাশি এক ভাইকে বিয়ে করিয়েছি, বোনের বিয়ে দিয়েছি।

পর্যটন মৌসুমে টানা ৪ মাস ঘোড়া প্রতি আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয়ের কথা অকপটে মেনে নিলেও আয় বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ ঘোড়ার মালিকের খাবার যোগান দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে দাবি করেন তিনি।

৩০টি ঘোড়া মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কেন অবগত করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তখন বিষয়টা সিরিয়াসলি ভাবা হয়নি।

কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা ডা. অসিম বরণ সেন বলেন, ঘোড়ার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে ঘোড়া মারা যাওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। আমার জানা মতে গত এক বছরে তিনটি ঘোড়া মারা গেছে। তাও বার্ধক্যজনিত ও নানা অসুস্থতার কারণে। কারণ আমরা ঘোড়া মালিকদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। আগামীতেও এ সহায়তা অব্যাহত থাকবে

তিনি আরও বলেন, এরপরও বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরটি আসার পর প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। উক্ত কমিটিকে আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কমিটিতে কক্সবাজার প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. নেবু লাল দত্তকে প্রধান করা হয়েছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন কক্সবাজার প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের উপ-সহকারি কর্মকর্তা ডা. মিজবাহ উদ্দিন কুতুবী ও ডা. এহসানুল হক।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের (পর্যটন ও প্রটোকল) সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, সৈকতে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য ২২ জন ঘোড়া মালিককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যে পরিমাণ ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, এর কোন তালিকা আমাদের কাছে নেই। মালিকরাও কখনো এ বিষয়ে আমাদের জানায়নি।

তিনি আরও বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে সৈকত ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হলে ঘোড়া মালিকদের আয় বন্ধ হয়ে যায় এবং ঘোড়াগুলো খাদ্য সংকটে পড়ে। এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূষি ও ছোলা বিতরণ করা হয়। খাদ্য সংকট থাকার কথা নয়।

‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ঘোড়াগুলোর মালিকদের অমানবিক আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। মালিকরা এতদিন ধরে ঘোড়াগুলোকে দিয়ে টাকা আয় করেছে। আজ করোনা সংকটে ঘোড়াগুলোকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ঘোড়ার মালিকদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা উচিত।

এদিকে, কক্সবাজার সৈকতের ঘোড়াগুলোর খাদ্য সংকটের খবরে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৫৫টি ঘোড়ার জন্য মালিকদের হাতে এক মাসের খাদ্য সহায়তা তুলে দিয়েছে।

তার আগে দুই দফা খাবার দিয়েছে প্রাণি সম্পদ বিভাগ।