সিবিএন ডেস্ক:
এক কোটি দুই কোটি নয়; মোট ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ তাদের ঘাড়ে। তারা সবাই চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু তাদের কেউই এখন চট্টগ্রামে থাকেন না। পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তবে সেটাকে বলা চলে পালিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন চট্টগ্রামের ২০ প্রতিষ্ঠানের ২৪ ব্যবসায়ী।

এসব ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১৩ জন রয়েছেন কানাডায়। এছাড়া তিনজন মালেশিয়া, দুজন লন্ডন (ইউকে), দুজন আমেরিকা এবং একজন করে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, মন্টেনিগ্রো, সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাতে। ভোগ্যপণ্য, শিপ ব্রেকিং, গার্মেন্টস, আবাসন, কৃষি ও পরিবহন খাতে এসব ঋণ দিয়েছিল দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে পাঁচ তারকা হোটেল, আবাসন, সুপার শপ ও পেট্রোল পাম্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। এতে ব্যাংকের পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও পালিয়ে যাওয়া ঋণখেলাপিরা আছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যাংকের মামলা রয়েছে। এদের অনেকেই সাজাপ্রাপ্ত আবার অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।

পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওনা রয়েছে মোস্তফা গ্রুপের কাছে। এই শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকসহ ৩০ টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এসব পাওনা পরিশোধ না করে ২০১৯ সালের শেষ দিকে কানাডায় পাড়ি জমান গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন।

ভোগ্যপণ্য, পরিবহন ও জাহাজভাঙ্গা শিল্পে এক সময় দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করতো চট্টগ্রামের মোস্তফা গ্রুপ। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই মোস্তফা গ্রুপের অবস্থা এখন নাজুক। যুগের যুগের পর যুগ ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় লিড দিয়ে আসা গ্রুপটি গত কয়েক বছর ধরে ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় নেই। শিপ ব্রেকিং এসোসিয়েশনের দীর্ঘদিনের সভাপতি হেফাজতুর রহমানের মোস্তফা গ্রুপের ব্যবসা নেই শিপ ব্রেকিংয়েও। বন্ধ হয়ে গেছে গ্রুপটির ভোগ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, শিপ ব্রেকিং, কৃষি, কাগজ, মৎস, পরিবহণ, শিপিং, সিকিউরিটিজ ও পোষাক খাতের বহু প্রতিষ্ঠান।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনা পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়েছেন মিশম্যাক গ্রুপের তিন সহোদর হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান শাহীন ও মুজিবুর রহমান মিলন। শিপ ব্রেকিং ও আবাসন খাতে ব্যবসা করা গ্রুপটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

২০০৯-১০ সালের ব্যবসা শুরু করে ২০১২ সালেই খেলাপি হয়ে পড়ে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠানগুলো। অভিযোগ রয়েছে- প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্ণধার ব্যবসার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পাচার করেছেন বিদেশে। পরে ২০১৩ সালেই তিন সহোদর দেশ ত্যাগ করেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে বর্তমানে মিজানুর রহমান শাহীন ও হুমায়ুন কবির সপরিবারে কানাডায় অবস্থান করছেন। মুজিবুর রহমান মিলন থাকেন সিঙ্গাপুরে।

ভোগ্যপণ্য আমদানিতে দ্রুত সময়ে প্রসার ঘটে খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি বড় পরিসরে ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেয়। পরবর্তীতে ব্যাংকের দায় না মিটিয়েই ২০১৪ সালের শুরুর দিকে সপরিবারে কানাডা পাড়ি দেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মোজাহের হোসেন। ইয়াছির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ও শাপলা ফ্লাওয়ার মিলসে বিভিন্ন ব্যাংকের বর্তমানে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে আছে। যা পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

৫৫ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে দুবাইয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ইমাম গ্রুপের র্কর্ণধার মোহাম্মদ আলী। এই ব্যবসায়ীর কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। পাওনাদার ব্যাংকগুলোর দায়ের করা মামলায় সাজা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আরব আমিরাতে পালিয়ে যান এই ব্যবসায়ী। বর্তমানে তিনি আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন এবং সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।

নব্বইয়ের দশকে খাতুনগঞ্জের ভোগ্য পণ্যের বড় জায়ান্ট ছিল ইমাম ট্রেডার্স। পরবর্তীতে ভোগ্যপণ্য থেকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে গার্মেন্টস, যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নানা খাতে। এসব খাতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিলেও পরে সেই টাকার বেশির ভাগ বিনিয়োগ করেছে জমি কিনতে।

ভোগ্যপণ্য ছেড়ে ২০০৭ সালে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা শুরু করেন ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী তিন ভাই— জয়নাল আবেদিন, জামিল আবেদিন ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে এ ব্যবসা করেন তারা। এরপর ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করেই সপরিবারে কানাডা পাড়ি জমান জয়নাল আবেদিন। আর জামিল আবেদিন পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কাছে ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৮০০ কোটি টাকার বেশি।

ক্রিস্টাল গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার কানিজ ফাতিমা রাশেদ। তিনি ও তাঁর স্বামী রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম দুইজনই চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টাল গ্রুপের পরিচালক। গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বে নেভিগেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বেও আছেন কানিজ ফাতিমা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রুপটির ৮০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়লে কানাডা পাড়ি জমান কানিজ ফাতেমা।

২০১০ সালে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে ব্যবসা শুরু করেন সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি এলাকার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন কুসুম। এর আগে কোন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়েও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ৬০০ কোটি টাকার ঋণ নেন এই ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা করলেও ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে ২০১৫ সালে কানাডা পাড়ি জমান এই ব্যবসায়ী।

চার ব্যাংকের ৫২৫ কোটি টাকা নিয়ে কানাডা পালিয়ে রয়েছে লিজেন্ড হোল্ডিংস’র স্বত্বাধিকারী এস এম আব্দুল হাই।

শিপ ইয়ার্ড, রপ্তানি পোষাক ও আবাসন খাতে ব্যবসা করতেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার বাসিন্দা এস এম আব্দুল হাই। বড় শিল্প গ্রুপ কেডিএস’র চেয়ারম্যানের জামাতা হওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পান এই ব্যবসায়ী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের ঋণ শোধ না করে ২০১৭ সালে স্বপরিবারে কানাডা পাড়ি জমান এই ব্যবসায়ী।

চট্টগ্রামের বনেদি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাদশা গ্রুপ। একসময় নগরীর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা বাদশা মিয়া সওদাগার তালা মার্কা সাবান ও ভোজ্যতেলের ব্যবসা করলেও পরবর্তীতে তাঁর দুই ছেলে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে ভোগ্যপণ্য আমদানি, ডেইরি ও জাহাজ ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন খাতে। বাবার সুনামকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পায় বাদশা গ্রুপের দুই সহোদর ইসা বাদশা ও মসুা বাদশা।

বাবার সুনামকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক ঋণ নিলেও ব্যবসার পরিবর্তে সেই টাকা পাচার করেছে বিদেশে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের শেষ দিকে স্বপরিবারে কানাডা পাড়ি জমান দুই সহদোর। এই গ্রুপটির কাছে আট ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকা আটকে গেছে।

বর্তমানে দুই সহোদর কানাডার টরন্টোর লেকশোর এলাকায় বসবাস করছেন। লেকশোরে তাদের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী। ভোগ্য পণ্য আমদানি, স্ক্র্যাপ, শিপ ইয়ার্ড, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং, এগ্রো, সিএনজি ফিলিং স্টেশন, বেভারেজ ও ম্যানফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করতে ঋণ নেন এই ব্যবসায়ী। তবে ব্যবসার জন্য নেয়া ঋণ ভ’মিতে বিনিয়োগ ও ইউরোপের মন্টেনিগ্রোতে পাচারের অভিযোগ রয়েছে এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। এই ব্যবসায়ীর কাছে ৬ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পাওনা ৪০০ কোটি টাকা।

মন্টেনিগ্রোয় ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ও ওয়েস্টিন নামে দুটি পাঁচতারকা হোটেলে ৬ কোটি ইউরো বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬০৩ কোটি টাকায় নির্মিতব্য হোটেল দুটি ছাড়াও সেখানকার আবাসন খাতেও বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে আব্দুল আলিম চৌধুরীর। মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের অর্থ বিদেশে পাচারের মাধ্যমেই এ বিনিয়োগ গড়ে তুলেছেন তিনি।

চার ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন পোষাক কারখানার মালিক নাজমুল আবেদিন।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের অর্ন্তগত পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এ এন্ড বি আউটওয়্যার লিমিটেড, নর্ম আউটফিট লিমিটেড ও ক্লোড প্লে লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান তিনটির কর্ণধার (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) লন্ডনি নাগরিক নাজমুল আবেদিন।

সিলেটের নাজমুল আবেদিন ২০১৫ সালের দিকে চট্টগ্রামের সিইপিজেডে পোষাক খাতের ব্যবসা শুরু করেন।

এরপর কাঁচামাল আমদানির এলসি ও পরিচালন মূলধন হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেন তিনি। তবে কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি বা ব্যবসায় মুনাফা নয়, নাজমুল আবেদিনের মূল টার্গেট ছিল ব্যাংক থেকে ঋণ হাতিয়ে নেয়া। এই ঋণের বেশির ভাগ টাকায় ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিবর্তে কাঁচামাল আমদানিসহ বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে পাচার করেছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি লন্ডন থেকে আর দেশে ফিরেন নি।

গত দুই বছর ধরে মালেশিয়া পালিয়ে রয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী শাহ আলম। এক সময় ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় থাকা মেসার্স আলম এন্ড কোং এর এই স্বত্বাধিকারীর কাছে আট ব্যাংকের বর্তমান পাওনা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

পাওনাদার ব্যাংকের তথ্যমতে, এই পাওনার বিপরীতে ব্যবসায়ী শাহ আলমের বিরুদ্ধে আটটি ব্যাংক এই পর্যন্ত ৫৪ টি মামলা দায়ের করেছে। এরমধ্যে ৪৭ টি এন আই অ্যাক্টে দায়ের করা মামলা। বাকি ৭ টি অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা। এরমধ্যে গত বছরের বিভিন্ন সময়ে রায় হওয়া এন আই অ্যাক্টের ৬ মামলায় ৬ বছরের সাজা হয়েছে শাহ আলমের। এছাড়া অর্থঋণের ৪ মামলায়ও রায় হয়েছে। এসব মামলায় রায় হওয়ার আগেই ২০১৮ সালের শেষ দিকে স্ত্রীসহ দেশত্যাগ করেন এই ব্যবসায়ী

তিন ব্যাংকের ২৮০ কোটি টাকা পাওনা বকেয়া রেখে আমেরিকায় পালিয়ে আছেন চট্টগ্রামের পোষাক খাতের ব্যবসায়ী ও সিএন্ডএ গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ মোরশেদ। যেই টাকার বেশিরভাগই খেলাপি ও শ্রেণিকৃত ঋণে পরিণত হয়েছে।

পূর্বপুরুষের হাত ধরে পোষাক খাতের ব্যবসায় আসেন চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মোরশেদ। সিএন্ডএ টেক্সটাইলের শুরুর দিকটা ভালোই ছিল। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সাথে যোগ হয় ইফকো গার্মেন্টস ও সামরোজ গার্মেন্টস। কিন্তু ২০১৫ সালের দিকে পারিবারিক কলহে জড়িয়ে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে।

২০১৬ সালের শেষ দিকে মোরশেদের মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠানেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালের শুরুর দিকে সুযোগ বুঝে তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যান এই ব্যবসায়ী।

চার ব্যাংকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ না করেই অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছেন চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী মাকসুদুল আলম।

ম্যাফ ইন্টারন্যাশনালের এ স্বত্বাধিকারী ২০০৮-০৯ সালের দিকে ফল, বিটুমিন, কেমিক্যালসহ ভোগ্যপণ্য আমদানির ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছর ব্যবসা করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেন। কিন্তু ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে ২০১৪ সালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এখন পেট্রল পাম্পের ব্যবসা করছেন বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের জাহিদ হোসেন মিয়ার প্রতিষ্ঠান ‘জাহিদ এন্টারপ্রাইজ’। এক সময়ের গ্রামীণ ফোন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ১৮৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জাহিদ হোসেন গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও জাহিদের স্ত্রী মাহবুবা আক্তার জাহিদ পাড়ি জমিয়েছেন মালেশিয়ায়।

২০১৩ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে রুটে পরিবহন ব্যবসা শুরু করে বাগদাদ গ্রুপ। তবে মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির পরিবহন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করা গ্রুপটির কাছে ৫ ব্যাংকের ১৫০ কোটি টাকা পাওনা আটকে যায়। অভিযোগ রয়েছে- পরিবহন ব্যবসা করে ব্যাংকের টাকা শোধ না করে এই টাকা নিয়ে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডা পালিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীর।

দুই ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে কানাডা পালিয়েছে চট্টগ্রামের ইফ্ফাত ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী দিদারুল আলম। দিদারুল আলম দীর্ঘদিন ধরে খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। তার বড় ভাই একটি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। সেই সুবাধে ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ সুবিধা পান তিনি। পরে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ব্যাংকের টাকা শোধ না করে স্ব পরিবারে কানাডা পাড়ি জমান এই ব্যবসায়ী।

দুই ব্যাংকের ৭১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে স্বপরিবারে মালেশিয়া পালিয়ে রয়েছে কেমিক্যাল ব্যবসায়ী আনোয়ারুল হক চৌধুরী।

চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে পণ্য পরিবহণ ব্যবসা করতো সার্ক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুল হক চৌধুরী। ২০০৭-০৮ সালের দিকে পরিবহণের পাশাপাশি কেমিক্যাল আমদানি শুরু করেন এই ব্যবসায়ী। ওই সময় কেমিক্যাল আমদানির নামে দুই ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। শুরুর দিকে যথাসময়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করলেও ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাংক ঋণ শোধ করে নি। এরপর ২০১২ সালের দিকে পাওনাদার ব্যাংক ঋণের টাকা আদায়ে মামলা করলে স্বপরিবারে মালেশিয়া পালিয়ে যান এই ব্যবসায়ী।

এন এম ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী এস এম শামীম ইকবাল। কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের জামাতা হওয়ায় এক সময় আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন এই ব্যবসায়ী। রপ্তানি পোষাক খাতে ব্যবসা করতে গিয়ে তিন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৬৭ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকের সেই টাকা শোধ না করে ২০১৯ সালে স্বপরিবারে কানাডা চলে যান এই ব্যবসায়ী।

বিভিন্ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকা পরিশোধ না করে ২০১২ সালে লন্ডন পাড়ি দেন খাতুনগঞ্জের এসএল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী লেয়াকত আলী চৌধুরী।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের বহু ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে সেখানে ঘর-বাড়ি কিনেছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। যেটি সরকারেরও জানা রয়েছে। এভাবে দেশের জনগণের টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকানো সরকারেরই দায়িত্ব। কিন্তু সরকার বিষয়টি প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সোনালী ব্যাংকের জিএম মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা খেলাপি হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছেকৃতভাবে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এসব খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করছে। কিন্তু বিদেশ পালিয়ে যাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ছে।

অর্থঋণ আদালতের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আবুল হাসান শাহাবউদ্দিন বলেন, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে তাকে বিদেশ যেতে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ঋণখেলাপিই পালিয়ে দেশত্যাগ করে বিদেশে শান্তিতে বসবাস করছেন। এমনকি বিদেশে অবস্থান করেই কোনো কোনো খেলাপি গ্রাহক ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড