মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে আশংকাজনক ভাবে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংক্রমণ ঠেকাতে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জরুরীভিত্তিতে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গবেষণারত চিকিৎসক ও রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করেন এমন অভিজ্ঞজনেরা এ মন্তব্য করেছেন।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির এর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের করোনা ভ্যাকসিনের আওতায় আনা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে অতিমাত্রায় ঘনবসতি ও তাদের বসবাসের কক্ষের সাথে সংযুক্ত বাথরুম নাথাকা সহ হোম আইসোলেশনের জন্য অন্যান্য সুবিধাসম্পন্ন উপযুক্ত ঘর না থাকায় করোনা নিয়ন্ত্রণের বাকী স্বাস্থ্যবিধি গুলো এখানে খুুব একটা প্রতিপালিত হচ্ছেনা। উক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, করোনা শনাক্ত হওয়া রোহিঙ্গারা তাদের ক্যাম্প থেকে নির্ধারিত SARI আইসোলেন সেন্টারে যেতে চায়না। তারা আইসোলেসন সেন্টারকে অনেকটা কারাগার মনে করে। আবার, করোনা শনাক্ত হওয়া রোহিঙ্গাদের স্বজনেরাও তাকে আইসোলেসন সেন্টারে যেতে দিতে চায়না।

করোনা সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণে গবেষণারত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির আরো বলেন, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে করোনা ঠেকাতে ভ্যাক্সিনেশনই একমাত্র সমাধান। তিনি আরো বলেন, আমেরিকায় ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে দৈনিক ৩ লক্ষ রোগী শনাক্ত করা থেকে মাত্র ৫ হাজার রোগীতে নামিয়ে এনেছে। ভারতও অনুরূপভাবে দৈনিক ৩ লক্ষ রোগী থেকে ২ লক্ষ এর নীচে নিয়ে এসছে। সুতরাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও এর বিকল্প নাই।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরনার্থী নিয়ে গবেষণা করেন, এমন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেছেন, প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যে ৪০ বছর বয়স উর্ধ্ব রোহিঙ্গা ৩ লাখের বেশি হবেনা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত সরকারি, জাতিসংঘের সংস্থা, আইএনজিও, এনজিও, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ইত্যাদি মিলেয়ে ৫০ হাজারেরও কম হবে। প্রায় মোট সাড়ে ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা ও অন্যান্যদের প্রতিজনের জন্য ২ ডোজ করে সর্বোচ্চ ৭ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন আমদানি করলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অতি সহজে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধ করা যাবে। কোন কোম্পানির ভ্যাকসিনটি রোহিঙ্গাদের জন্য বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে উক্ত অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, চীনের সিনেফার্মা ও ফাইজারের বায়োএনটেক নামক ৪ টি ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে। তার যেকোন একটি আমদানি করলেই চলে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation-WHO) এর সহায়তায় এ গুলো সহজেই রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য আমদানি করা যায়। উক্ত অধ্যাপকের মতে, অনেক আগেই রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনা উচিত ছিলো। কেন রোহিঙ্গা শরনার্থী ব্যবস্থাপনায় সংপৃক্তরা আগে থেকে ভ্যাকসিন আনার উদ্যোগ নিলেন না-এ বিষয়টা উক্ত অধ্যাপকের কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরনার্থী ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে। কক্সবাজার আরআরআরসি অফিস এ বিষয়ে
প্রাথমিক সকল প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। ভ্যাকসিন আমদানীর জন্য চীনের সিনোফার্মার সাথে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, সে অনুযায়ী আগামী আগস্টের প্রথমদিকে চীন থেকে সিনোফার্মার এসব ভ্যাকসিন আসতে পারে। চীন থেকে থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত সিনোফার্মার ভ্যাকসিন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের তা প্রয়োগ করা হবে বলে ভিন্ন একটি সুত্র জানিয়েছে। তবে ততদিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রামণ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশংকা পোষন করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যে ২৮ মে পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ১৬৭ জন। একইসময়ে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছে ১৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী। একইসময়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় নাগরিক মারা গেছে ৯৫ জন। অর্থাৎ ১৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী সহ গত ১৪ মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার জেলায় মৃত্যুবরণ করেছে মোট ১১২ জন।

২৮ মে পর্যন্ত কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে মোট ৪৩ হাজার ২৬৮ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর নমুনা টেস্ট করে এ ১ হাজার ১৬৭ জনের রিপোর্ট পজেটিভ আসে। তারমধ্যে, উখিয়ার ক্যাম্প গুলোতে ৯৫২ জন এবং টেকনাফের ক্যাম্প গুলোতে ১৯৩ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর দেহে করোনা শনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৭৬২ জন সুস্থ হয়েছেন। ২৮ মে পর্যন্ত অসুস্থ আছে ৩৮৯ জন। তারমধ্যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহের অভ্যন্তরে থাকা আইসোলেসন সেন্টার গুলোতে ২৩৮ জন করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা শরনার্থী আইসোলেসনে রয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরো ৬ জন করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা শরনার্থী। গত ১৮ মে থেকে গত ২৭ মে পর্যন্ত ১০ দিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে গড়ে ৩৪ জন করে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে করোনা সংক্রামণ দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। আক্রান্ত ১ হাজার ১৬৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর মধ্যে শুরু থেকে গত ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ শতের নীচে। মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৮ শতেরও বেশি। শরনার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ১৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টারে ৯৬৪ টি বেড রয়েছে। আরো ৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টার চালুর অপেক্ষায় আছে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে।

এদিকে, উখিয়া-টেকনাফে থাকা ৩৪ রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ৫ টিতে করোনা সংক্রামণ আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় গত ২০ মে থেকে ৫ টিতে লকডাউন (Lockdown) চলছে। এই লকডাউন আগামী ৩১ মে পর্যন্ত চলবে। লকডাউন কার্যকরে সরকারের করোনা সংক্রান্ত নির্দেশনা মতে কাজ চলছে। এছাড়া, অবশিষ্ট ২৯ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে অত্যাবশ্যকীয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব নিয়মিত কার্যক্রম গত ২০ মে থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো লকডাউন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে -কুতুপালং ওয়েস্ট ২, ৩, ৪, ১৫ ও ২৪ নম্বর। এ ক্যাম্প গুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম শরনার্থী শিবির বলে খ্যাত উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের প্রত্যেকটিতে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তবে লকডাউন করা উল্লেখিত ৫ টি ক্যাম্পে অপেক্ষাকৃত বেশী করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।