ইউসুফ আরমান:
ইদানিং জেলা জুড়ে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্ধের রেশ ধরে নৃশংস খুনের ঘটনা ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। নীতি নৈতিকতা আর সামাজিক অবক্ষয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অনাকাংক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি। কেন ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা।

অর্থ মানুষকে লোভী করে তোলে, সে যে কোন উপায়ে। অতিরিক্ত ধন সম্পদ অর্জনে প্রেয়সী হয় এবং সে নৈতিকতার ধার ধারে না। ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নৈতিকতার অধঃপতন ঘটাতে পারে। প্রেম-ভালবাসা, সহানুভূতি, দয়ামায়া, সব কিছুই অর্থের নিরিখ বিচার করা হয়। এক্ষেত্রে আগ্রহের বিষয় হচ্ছে সম্পত্তি, মূল্যবোধ নয়।

পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন আল্লাহ পাকের এক বিশেষ নি‘আমত। কিন্তু যদি পরস্পরের লেনদেনে স্বচ্ছতা না থাকে তাহলে আত্মীয়তার পরিবর্তে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, যা এক সময় ভয়ংকর রূপ ধারণ করে পরস্পর সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।

পরিবারের মধ্যে টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকে বা আছে। পরিবারের জন্য এত কিছু করে কিন্তু টাকা-পয়সার বিষয়ে যখন পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বামীকে কিছুই জানায় না। এই কারণে কখনো কখনো সপ্তাহের-পর-সপ্তাহ ধরে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সঙ্গে কোনো কথাই বলে না।’

পরিবার বলতে কী বোঝায়? অথবা পরিবারের সদস্য কারা? ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি বা বাংলাদেশি রীতিতে স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। তবে এটি পরিবারের অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ। মাঝারি আকারের একটি পরিবারে বাবা-মাও সদস্য। বড় বা একান্নবর্তী পরিবারে ভাই-বোন, দাদা-দাদিও সদস্য হতে পারেন। একটি পরিবার হচ্ছে একটি বন্ধন, আমৃত্যু অটুট থাকার নাম, সুখে-দুঃখে পাশে থাকার নাম, সর্বদা ভরসা (সাপোর্ট) দেয়ার নাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কালের বিবর্তনে আমাদের পরিবারগুলোর বন্ধন, সদস্যদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য যেন ম্রিয়মাণ একটি প্রদীপ! আর তাই একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে বহু আগেই। বেদনাদায়ক সত্য হচ্ছে, এখন বাবা-মাকেও পরিবারের সদস্য মনে করেন না কেউ কেউ! কিন্তু আমার কাছে বাবা-মাবিহীন পরিবারের ধারণা অসম্পূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। একটি পরিবারে অবশ্যই বাবা-মাকে অপরিহার্য সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পারিবারিক সম্পর্কের বৃত্তে আবদ্ধ আমরা সবাই যদি এই সত্যটি উপলব্ধি করতাম বা বিশ্বাস করতাম, তাহলে আমাদের সবার জীবন ও প্রতিটি সম্পর্ক মধুর চেয়েও মিষ্টি হতো। একজন পুরুষের প্রবাস জীবন কেমন হয় বা হতো!

প্রবাসে থাকলেই কি সুখে থাকা যায়? প্রবাস একটা হতাশার নাম। প্রবাস মানে এক অবিশ্বাসের জগৎ। একটা সময়ের পর পিতা-মাতা, ভাই-বোন এমনকি স্ত্রীও বিশ্বাস করেন না। একমাত্র যারা সহকর্মী তারাই একে অপরের সাথী। তারা ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে না যে প্রবাসে সুখ নয়, শুধু কষ্ট আছে। এতো সহজে টাকা আয় করা যায় না এখানে।
প্রবাসীর জীবনে থাকে একটা নির্ঘুম রাত, ছুটে চলা বাস-ট্রেনের একটি ভোর, কাজে যাওয়ার তাড়া, মালিকের অসহ্য কুরুচিপূর্ণ ভাষা, ক্ষুধার্ত দুপুর, অবসন্ন একটি বিকেল। তারপর ক্লান্ত গোধূলিলগ্নে চোখ কপালে তোলা শুকিয়ে যাওয়া সাদা ঠোঁটের মলিন মুখ।

কাজ শেষে ঘরেফেরা বেদনার্ত রাত। যদি এইসব অনুভূতি প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়া যেতো, তাহলে প্রবাসীর সুখের সাথে চোখের জল কি আটকাতে পারতো আপনজন!

হাজার হাজার মাইল দূর প্রবাসী কেবল স্বপ্নের বীজ বুনে যায়। মনের খাঁচায় পাওয়া না পাওয়ার বেদনায়, কষ্টের তীব্রতায় আর প্রিয়জনের বিশ্বাসহীনতায়। কতজন নিঃস্ব হয়ে যায়- অর্থে নিঃস্ব, ভালোবাসায় নিঃশ্ব।

তবে হ্যাঁ- একটা মানুষের জীবন বিসর্জন দেওয়া কষ্টে যদি তার পরিবারের পাঁচ ছয়টা প্রাণ খেয়েপরে বাঁচে, তাহলে এই প্রবাসকে ভালো বলা যায়। এটা ঠিক, এক প্রবাসীর সঙ্গে জুড়ে আছে অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন, কারো কারো বেঁচে থাকা, কারো ভালো থাকা, কারো বিলাসিতা। এভাবে কারো সংসার ভাঙে, আবার কেউ যৌতুকের বেড়াকলে ফেঁসে যান। কেউ করে নির্যাতন, কেউ হয় নির্যাতিত। কেউ সব ভুলে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন।

প্রবাসী ছেলের জন্য মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের কন্যা দায়গ্রস্ত পরিবার অপেক্ষায় থাকেন। ছেলে বিদেশ থাকে এমন পাত্রের অনেক দাম। অনেকেই আছেন বিয়ে করতে দেশে যান। তারপর নানা জটিলতায় আর বিদেশ ফেরত আসতে পারেন না। আজ যাচ্ছি, কাল যাচ্ছি করে সময় কেটে যায়। এইভাবে বাড়ছে পারিবারিক বিবাদ সেই সাথে বাড়ছে নৃশংস খুনের ঘটনা। গেলো কয়েক দিনে হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পারিবারিক বিবাদে খুনই বেশি।

কি কারণে ঘটছে এ ধরণের নৃশংসতা? সমাজে লোভ-লালসা, পুরুষের কষ্টে উপার্জিত অর্থ আত্মসাৎ, অনৈতিক ও আপত্তিকর কর্মকাণ্ডে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বাড়ছে মাদকের বিস্তার, প্রতিহিংসা, হতাশা, অবিশ্বাস আর মানসিক বিষন্নতা। পারিবারিক হত্যাকাণ্ড শুধু আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। যদি মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশ না ঘটে।

ইউসুফ আরমান
কলামিস্ট ও সাহিত্যিক
দক্ষিণ সাহিত্যিকাপল্লী
০৬ নং ওয়ার্ড, পৌরসভা
কক্সবাজার। 01615-804388
yousufarmancox@gmail.com