আবদুর রহমান, বাংলাট্রিবিউন, টেকনাফ: কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ওই দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার শরণার্থী নেতারা। পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখেই ভাসানচর থেকে তাদের অনেকে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। তবে পুলিশের তথ্যমতে, সংখ্যাটি আরও কম এবং পালাতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন কয়েকজন। গত ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হওয়ার পর এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছান। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, সব রোহিঙ্গাই সেখানে স্বেচ্ছায় গেছেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে সেখান থেকে ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের গুচ্ছগ্রামের একাধিক রোহিঙ্গা নেতা।

সর্বশেষ সোমবার (১৭ মে) নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালিয়ে নূরুল আমিন (২০) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক কক্সবাজারের টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানান ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ‘রোহিঙ্গা নুরুল আমিন দালালের মাধ্যমে গোপনে ভাসানচর থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা শিবিরে পরিবারের অপর সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করছেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবগত করা হয়েছে।’

তবে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ভাসানচরে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধি ও ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) রঞ্জন চন্দ্র দে বলেন, ‘১২-১৩ জন পলাতক রোহিঙ্গার একটি তালিকা আমরা পেয়েছি।’ একমত পোষণ করে ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই চর থেকে ২০-২২ জনের মতো রোহিঙ্গা পালানোর খবর রয়েছে আমাদের কাছে।’

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা (ছবি: ফোকাস বাংলা)ভাসানচরে রোহিঙ্গারা (ছবি: ফোকাস বাংলা)যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি গুচ্ছগ্রামের ‘ফোকাল’ (সমন্বয়ক) রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘এখান থেকে ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গা পালিয়েছেন। সর্বশেষ গত বুধবার বিকালে বেড়িবাঁধ থেকে পালানোর চেষ্টা করা চার রোহিঙ্গাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’ আরেক গুচ্ছগ্রামের নেতা বলেন, ‘গত চার-পাঁচ মাসে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে পালিয়ে গেছেন। আরও অনেকে পালানোর চেষ্টাকালে ধরা পড়েছেন। তাদের অনেককে কারাগারেও যেতে হয়েছে। তবু পালানোর চেষ্টা থামেনি।’

এ বিষয়ে ওসি মাহে আলম বলেন, ‘ভাসানচরে থেকে রোহিঙ্গারা প্রায়ই পালানোর চেষ্টা করে। তবে এমন অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়েছি আমরা।’ পালিয়ে যাওয়া বা পালানোর চেষ্টা করা অনেকে ফিরেও এসেছে জানিয়ে সিআইসি রঞ্জন বলেন, ‘মাঝে মাঝে যায়, আবার ফেরত আসে, এমন ঘটনাই বেশি ঘটছে।’ তবে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, মাত্র একজন পলাতক রোহিঙ্গা ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচর ছেড়ে পালানোর বিষয়টি অবগত থাকার কথা জানিয়ে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘পলাতকরা ভাসানচর থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে আটক হওয়া রোহিঙ্গা। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা এটা ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

‘গত ডিসেম্বর থেকে ভাসারচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরুর যে সরকারি সিদ্ধান্ত, তাতে দূরদর্শিতার অভাব ছিল বলেই এমনটা ঘটছে’ উল্লেখ করেন অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর। তিনি বলেন, ‘সরকার নিজে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তর করেছে। এখন সেখান থেকে কেউ পালিয়ে গেলে তার দায়টাও সরকারের ওপরই বর্তাবে।’

‘এক্ষেত্রে সরকার হয়তো বলবে, যে পরিমাণ নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই তুলনায় পালিয়ে যাওয়ার হার খুবই কম, বেশিরভাগই ভাসানচরে ভালো আছে। কিন্তু একজন মানুষও যদি পালিয়ে থাকে সেটার কারণ খতিয়ে দেখা উচিত,’ বলেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কর্মকর্তা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এমন একটি জনগোষ্ঠী, তাদের যেখানেই রাখা হোক না কেন তারা পালানোর বা নানা অপরাধে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। পৃথিবীতে যারাই তাদের মতো জোরপূর্বক উদ্বাস্তু হয়েছে তারা অন্য কোথাও স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে পারেনি। তাছাড়া ভাসানচরের চারদিকে সমুদ্রের যে বিশাল জলরাশি, এটা রোহিঙ্গাদের জন্য সমস্যা না। রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা তারা যুগ যুগ ধরেই করে আসছে। নাফ নদী সাঁতরে টেকনাফে চলে আসার নজিরও আমরা দেখেছি।’

এটা ঠেকাতে ভাসানচরে নজরদারি বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘এক্ষেত্রে জনবলের কোনও সংকট থাকলে সেটা বাড়ানো দরকার।’

যেভাবে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা

সম্প্রতি (গত শনিবার) চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের চৌধুরী বাজার থেকে আটক হয় ভাসানচরের তিন রোহিঙ্গা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছেন, সাগরে তিনঘণ্টা সাঁতার কেটে সন্দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি জেলেরা তাদের নৌযানে তুলে সেখানে নিয়ে গেছে।

সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বশির আহমেদ খান বলেন, ‘জেলেরা তাদের সাগরে সাঁতরাতে দেখে কাছে গিয়ে জানতে পারেন তারা রোহিঙ্গা, ভাসানচর থেকে পালিয়ে এসেছেন। এরপর তাদের ট্রলারে তুলে নিয়ে এসে মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদে সোপর্দ করেন জেলেরা।’ আটক তিন জনের নাম নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ নাসিম ও আবদুল হামিদ। তারা ভাসানচরের ৪৯ ও ৬২ নম্বর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার কথা বলেছেন উল্লেখ করে ওসি বশির বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে তারা স্বেচ্ছায়ই ভাসানচরে গিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।’

তাদের বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সম্পর্কিত আইনে মামলা দিয়ে গত রবিবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ভাসানচরের ওসি আলমও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা আরও জানান, তাদের জামিনে মুক্ত করে পুনরায় ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

উখিয়া কুতুপালংয়ের হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ হামিদ বলেন, ‘তিন মাস আগে আমার ক্যাম্পের বিশ পরিবার ভাসানচরে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকে একটি পরিবারের এক পুরুষ সদস্য গত মাসের শেষের দিকে পালিয়ে এখানে ফিরে এসেছে।’ ওই রোহিঙ্গার নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানালেও তিনি বলেন, ‘প্রথমে সাঁতরে, পরে জেলেদের নৌযানে করে পালিয়ে আসার কথা জানিয়েছে ফিরে আসা ওই ব্যক্তি।’

পরিবার রেখেই পালাচ্ছে

গত ডিসেম্বরে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের একজন আসমিদা বেগম (১৯)। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মোহাম্মদ রফিক ১৭ দিন আগে এখান থেকে পালিয়েছে। সেদিন সাহরির সময় ভাত খেয়ে বেরিয়ে ফিরে আসেনি। দুই দিন আগে ফোন করে জানিয়েছে, এখন বান্দরবানের আলীকদমে রয়েছে। ভাসানচরে ফিরে আসার কথা কিছুই বলেনি।’

কিছু দিন আগে ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়া আবদুল সালামের স্ত্রী রশিদা বেগম বলেন, ‘সন্ধ্যায় মাছ শিকারে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি। পরে ফোনে জানিয়েছে, সে ঢাকায় আছে।’

‘আমাদের পাশের ঘরের একজনও কিছু দিন আগে এভাবে হঠাৎ পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকেই পালানোর পাঁয়তারা করছিলেন তিনি’- যোগ করেন রশিদা।

কুতুপালংয়ের হাকিমপাড়ায় ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে রোহিঙ্গা নেতা হামিদ বলেন, ‘যদি সম্ভব হতো পরিবারকেও সঙ্গে নিয়ে আসতো, এমনটাই আমাদের বলেছে সে। তার দাবি, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরাও করতে পারছে না। সবাইকে একপ্রকার বন্দির মতোই থাকতে হচ্ছে।’

তবে ‘ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পটি উদ্বাস্তুদের জন্য স্বর্গতুল্য,’ দাবি করে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডর রাশেদ সাত্তার বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও শরণার্থীদের এত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নজির নেই।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। এর ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। ওই বছরের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। এর অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছায়।