ইউসুফ আরমান:
পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চল গুলোর মধ্যে একটি ফিলিস্তিন। যেখানে মানুষের বসবাস, জনসমষ্টি এবং সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত (যেখানে বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড অবস্থিত)। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে ফিলিস্তিনের জেরুজালেম ছিল মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র ভূখন্ড।

তুর্কি সুলতান ২য় সেলিমের ১৫৬৬-৭৬ খ্রিঃ রাজত্ব কালে ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যভূক্ত হয়। তখন ফিলিস্তিন তুর্কি প্রদেশ হিসেবে গণ্য করা হত। কিন্তু ফিলিস্তিনবাসী পরাধীনতা কে অপমানজনক মনে করত।

সিরিয়া, মিশর ও আরব ভূখন্ডে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে ফিলিস্তিনবাসী স্বাধীনতা লাভের প্রয়াস পায়।

ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিবর্গের চক্রান্তে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের কোণঠাসা করার জন্যে ইহুদি (ইসরায়েল) জিওনিষ্ট আন্দোলন শুরু।

বিশ্ব ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য কোন নিজস্ব রাষ্ট্র না থাকায় ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন ইহুদি (ইসরায়েল) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্স চক্রান্ত করে।

পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে ইহুদিরা (ইসরায়েল) বাস করছে তাদের ফিলিস্তিনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য তাগিদ দেয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশ্ব যুদ্ধের শেষে দলে দলে ইহুদিগণ ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ইহুদিগণ ফিলিস্তিনে এসে আবাস ভূমি সৃষ্টি করে। এইভাবে ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।

১৯১৯ খ্রিঃ প্যারিসে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে ফিলিস্তিনগণ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে স্বাভাবিক কারণে ফিলিস্তিনদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভের আশা ক্ষীণ হয়ে যায়। অন্য দিকে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের ছত্রছায়ায় দলে দলে ইহুদিগণ ফিলিস্তিনে এসে হিব্রু রাষ্ট্র গঠন করে।

ব্রিটিশ সরকারের বৈরী মনোভাবের ফলে ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্য সংঘর্ষ সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯২১, ১৯২৯ ও ১৯৩৬ খ্রিঃ আরব-ইহুদি দাঙ্গায় অনেক লোক প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ সরকার সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এ সমস্ত দাঙ্গা বন্ধ করলেও ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান হয় নি।

১৯৩৬ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার একটি রয়াল কমিশন নিয়োগ করে আরব ইহুদিদের বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করে। এই কমিশন ১৯৩৭ খ্রিঃ ফিলিস্তিন কে তিন খন্ডে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়। ব্রিটিশ-আরব ও ইহুদি অঞ্চল এই ঘৃণ্য প্রস্তাব টি ছিল সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রতিফলন। এ কারণে আরব সম্প্রদায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।

১৯৩৮ খ্রিঃ ২য় কমিশনে ফিলিস্তিন কে বিভক্ত করার পরিকল্পনা বর্জন করা হয়। কোন সমস্যার সমাধান হলো না। তখন ব্রিটিশ সরকার একটি পত্র প্রচার করে বলে যে দশ বছরের মধ্যে ১৯৪৭ খ্রিঃ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে যা আজও হয় নি।

জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন বিভক্ত করণের পক্ষে রায় দেয়। ফিলিস্তিন কে তিন খন্ডে বিভক্তির প্রস্তাব করা হল আরব রাষ্ট্র-ইহুদি রাষ্ট্র-জেরুজালেম রাষ্ট্র। ইহুদিগণ এই প্রস্তাব মেনে নিলেও আরব স্বার্থেরহানি হওয়ায় আরবগণ অস্ত্র ধারণ করল। ১৯৪৮ খ্রিঃ ইহুদি ও আরবদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবদের বিজয় যখন সুনিশ্চিত তখন ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জাতি সংঘ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ বিরতিকালে ইহুদিগণ আমেরিকা ও রাশিয়া থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে। এর ফলে আরবগণ ইহুদিদের কাছে পরাজিত হয়। ইহুদিগণ ফিলিস্তিনের একটি অংশ দখল করে তেলআবিবে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে। ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করে। আমেরিকা ও ব্রিটেন মদদে আরব ভূখন্ডে জিওনিষ্ট ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। ১৯৪৯ খ্রিঃ আরব রাষ্ট্র সমূহ বিরোধিতা করা সত্ত্বেও জাতি সংঘ ইহুদি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিল। আর সে স্বীকৃতির পরিণাম ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত সৃষ্টি পেছনে জাতিসংঘ দায়ি। সেই দায় জাতিসংঘ কখনো এড়াতে পারেন না।

পরবর্তীতে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত ও সহিংসতা শুরু। পুরো বিশ্ব কি জানে না ফিলিস্তিন সম্পর্কে! তারা সীমাহীন সমস্যা আর ট্র্যাজেডির শিকার। এই সমস্যা ফিলিস্তিনের আজ একদিনের নয়। যুগ যুগ ধরে চলছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর বর্বর ও পাশবিক আগ্রাসন।

রমজান আসলেই ইসরাইল নামক ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটি’ মুসলমানদের ওপর তার বর্বরোচিত হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর মুসলিম বিশ্ব নীরব হয়ে দেখতে থাকে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক বৃদ্ধসহ বহু মানুষ। দেখতে হয় সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে এই বাস্তবতাটা আরব বিশ্বের নেতারা এখনও বুঝলেন না, বা বুঝতে চাইলেন না। অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলেন। তা না হলে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, কুয়েত, ইরান, তুরস্ক, ইরাক, জর্ডানসহ আরও যেসব আরব দেশ আছে। তারা কেন নিষ্ক্রিয়?

এ নিয়ে ফিলিস্তিনিদেরও অভিযোগের শেষ নেই। যে আরব বিশ্বের প্রতি তাকিয়ে আছে ফিলিস্তিনি মজলুম জনতা সেই আরবরাই ফিলিস্তিনিদের দিকে মুখ তুলে তাকায় না।

আমরা ফিলিস্তিনিরা আরব দেশগুলো থেকে আরো বেশি সহযোগিতা আরো বেশি একশন প্রত্যাশা করছে। বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র জর্দান, সিরিয়া, লেবানান, মিশর এবং আলজেরিয়া থেকে। আমরা মনে করি সব আরব দেশ এবং মুসলিম দেশের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। ফিলিস্তিনিদের এবং আল আকসা মসজিদ রক্ষায় তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা দরকার।”

কিন্তু কী করছে এই আরব বিশ্ব? ইসরাইলের সাথে রঙ্গলীলায় ব্যস্ত। অথচ প্রতিদিন জুলুম নির্যাতন হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। হত্যা, হামলা, মামলা, উচ্ছেদ, ধরপাকড় সব কিছুই চলে সেখানে। অথচ এই বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করেছেন না, সবাই শুধু মিডিয়া পাড়ায় নিন্দা ও হুমকি দিচ্ছে, বাস্তবতা তার বিপরীতে।

শুধু আরব নেতারা না, প্রায় সব মুসলিম দেশের নেতারা তাদের গদি রক্ষায় ব্যস্ত। ইসরাইলের বিপক্ষে সত্যিকার অর্থেই কোন পদক্ষেপ নিলে তাদের গদি হারানোর ভয় আছে? আর মুসলিম বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সংস্থা ওআইসি। এটি তো একটি নাম সর্বস্ব সংগঠন। যে ওআইসির জন্মই হয়েছিল মসজিদে আকসা এবং ফিলিস্তিনের জন্য সেই প্রতিষ্ঠানটি গত ৫২ বছরে ফিলিস্তিনের জন্য কিছুই করলো না!

কারণ মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদে আকসা রক্ষার এই সংগ্রাম শুধু ফিলিস্তিনিদের একার সংগ্রাম না, এই সংগ্রাম সারা মুসলিম উম্মাহর সংগ্রাম। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এক জাতি, আমাদের একই আওয়াজ, একই বার্তা এবং একই লক্ষ্য আর তা হলো সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল আকসাকে মুক্ত করা।”

ইউসুফ আরমান
কলামিস্ট ও সাহিত্যিক
দক্ষিণ সাহিত্যিকাপল্লী
০৬ নং ওয়ার্ড, পৌরসভা
কক্সবাজার। 01615-804388
yousufarmancox@gmail.com