মাহদী হাসান রিয়াদ

‘মধ্যবিত্ত’ নামক একটি শব্দ আছে । এই একটি শব্দের মাঝে নিহিত থাকে হাজারটা গল্প। গল্পগুলো সাধারণ কোনো গল্প নয়। নয় কোনো গল্পমানবের কল্পকাহিনীও। এ গল্পগুলো রচিত হয়ে থাকে বাস্তবতার নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে। বিষাদ ভরা একবুক নিদারুণ যন্ত্রণা আর মনের ভেদ প্রকাশ করতে না পারার মাত্রাতিরিক্ত চাপাকষ্ট দিয়ে।

‘করোনা’ ভাইরাস পুরো বিশ্বকে আজ ঘায়েল করে রেখেছে। অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বিশ্ব। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভেঙেছে শিক্ষাব্যবস্থার হাত-পা! এরূপ হাজারটা সমস্যা জাপটে ধরেছে আমাদেরকে। এরপরও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, অসুস্থ পৃথিবী অনেকটা সুস্থের পথে। অচিরেই জনজীবনে ফিরে আসবে স্বস্তি।

করোনার প্রথম ইনিংস শেষ হতে না হতেই ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ইনিংস! তাও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে। তিলোত্তমা এই ব্যস্ত নগরী ফের প্রাণচাঞ্চল্য হারাতে যাচ্ছে। একটুআধটু চাঞ্চল্যতা খুঁজে পেতে না পেতেই ফের মুমূর্ষু হচ্ছে! অনিশ্চয়তার মেঘ যেন কাটছেই না। একেকটা দিন কাটছে এককোটি বছরের কষ্টের মধ্য দিয়ে। নগরবাসীর জন্য যেন প্রতিটি সকাল আসছে কেবলই হাহাকার আর দুঃসংবাদ নিয়ে।

অনেক দেশে ফের লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সেই লিস্ট থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। চলছে না গাড়ি, ঘুরছে না গাড়ির চাকা, খুলছে না দোকানপাট, জমছে না টঙ দোকানের চায়ের আড্ডা। ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও।

থমকে দাঁড়িয়েছে কামলাদের কর্মজীবন। চরম হুমকির মুখে আজ জনজীবন। তন্মধ্যে সবচে’ বেশি কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছে এই দেশের ৪২ শতাংশ মধ্যবিত্তরা। অনেকের কপালে তো অর্ধাহারে বেঁচে থাকার সৌভাগ্যটুকুও জুটছে না। ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণায় তারা ধুঁকেধুঁকে মরছে৷ আফসোস আর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই মানুষগুলোকে দেখার মতো, তাদের নিয়ে ভাবার মতো কেউ নেই। কারোর কাছ থেকে যে দু’পয়সা চেয়ে নেবে, সে সাহসটুকুও তারা করতে পারে না। লজ্জা নামক বেহায়া জিনিসটা তাদের বলনশক্তি কেড়ে নিয়েছে। পুতুল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ উচ্চবিত্তের ধনভাণ্ডার আছে। নিন্মবিত্তের আছে সরকারপ্রভু। আর মধ্যবিত্তদের আছে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য এক দীর্ঘশ্বাস!’

এইতো, সেদিন দুইনাম্বার গেইট থেকে রুবি গেইট যাচ্ছিলাম। পুরো রাস্তা ফাঁকা। নেই কোনো যানবাহন। লোকজনের আনাগোনাও তুলনামূলক কম। একপাশে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাইফুল ভাই। ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় অপেক্ষা করছে যাত্রীর জন্য। বেচারার চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম হতাশার ছাপ। কাছে যেতে না যেতেই উঠে দাঁড়ালেন। খুবই অমায়িক সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
— ভাইসাব, কই যাবেন?
— রুবি গেইট যাব৷ যাবেন?
— হ, যামু। ওঠেন।
— ভাড়া কত?
— আপনি যা দেন। হুজুর মানুষ গো লগে দামদর করি না। আমি মনে করি, এটা আদবের বরখেলাপ।

ওনার বিনম্র শ্রদ্ধাবোধকে সাদরে গ্রহণ করলাম৷ কিছুদূর যেতেই মনে খটকা লাগলো! রিকশা চালানোর স্টাইল কেমন জানি লাগছে। মোটকথা, বাকি আট-দশজন সাধারণ চালকের মতো স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন না তিনি। মনে হচ্ছে এ পেশায় তিনি একদমই নতুন।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি নতুন চালাচ্ছেন?’
— হ, নতুন চালাচ্ছি। তিনদিন হয়ছে রিকশা নিয়ে নামলাম।
— ও আচ্ছা। তো, হঠাৎ করে এ লাইনে কেন?
— কষ্টের কথা কারে কমু ভাইসাব! পেটের জ্বালায় এ পেশা বেছে নিতে হলো।
— কেন? হঠাৎ এ পেশায় আসার কারণ কী? আগে কী করতেন?
— ড্রাইভার আছিলাম, বাসের ড্রাইভার। লকডাউন দেওনের পর থেইকা গাড়ি চালাইতে পারতাছি না৷ জমানো অর্থও নেই যে তা দিয়ে কিছু সদাইপাতি খরিদ করুম! দুইদিন বনরুটি খাইয়া কোনোমতে দিন পার করছি। পোলামাইয়ারা অবশ্য এসব খাইতে চায় না। তারা অবুঝ শিশু। মাছভাত খাইয়া বড়ো হইছে। বনরুটিতে তাদের পোষায় না।

ভাইসাব, দেশ লকডাউন হওয়ার লগেলগে যদি ক্ষিধাও ডাউন হয়ে যেত, খুব ভালো হত। আহা, ক্ষিধা তো আর ডাউন হয় না। প্রতি বেলায় নিয়ম করে তার ঘুম ভাঙে৷ তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে আমগো ঘুম কাড়ে। তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে রিকশা নিয়ে নেমে পড়লাম। অন্তত অর্ধাহারে তো বাঁচবার পারতাছি। দিনশেষে মায়ের জন্য দুয়েকটা মেডিসিন নিয়ে যাওয়ার তাওফিকও হচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ। ক্ষিধার নিদারুণ যন্ত্রণায় এখন আর ছেলে-মেয়েদের ঘুমও ভাঙে না। দু’মুঠো অন্নের জন্য তারা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে না। রাত-বিরেতে মায়ের শ্বাসকষ্টও বাড়ছে না। তবে, জীবন যে কতটা জটিল-কঠিন হতে পারে, তা এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি৷

— ভাইসাব, বলতে গেলে আমি বহুত সুখে আছি। শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ হইলেও বাকিসব ঠিকাছে। আমার চেয়ে আরও বহুগুণ কষ্টে আছে অনেকেই! যারা কিনা লাজলজ্জার ভয়ে টুঁ শব্দও করতে পারতাছে না। হুটহাট যেকোনো কাজে লেগে যাওয়ার দুঃসাহস করার মতো বুকেরপাটা নেই তাদের। সর্বশেষ হারাইয়া নিঃস্ব প্রায়! না পারছে কষ্টের কথা কাউরে কইতে, না পারছে নীরবে সইতে!
দেইখেন, অতি শিগগিরই দেশে আত্মহত্যার হিড়িক পড়বে! মানুষজন লাইন ধরবে আত্মহত্যা করার জন্য। বাড়ির সদস্যরা অনাহারে থাকলে যে কী পরিমাণ কষ্ট হয়, আমি সাইফুল বুঝি!

ভাইসাব, দুয়েকটা কাজ করলে মধ্যবিত্তরা খুব সহজে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় আমার।
১.
সহযোগিতার নামে ফটোসেশন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মধ্যবিত্তদের বুকে গুলি করলেও অতটা আঘাত লাগবে না, যতটা আঘাত লাগে ত্রাণের পোটলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্যামেরা তাক করলে! ভুক্তভোগী হিসেবে এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারবো।
২.
করোনার এই করুণ অবস্থায় ধর্ম-বর্ণ, দলমতনির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে চলে আসতে হবে। নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে ধনী-গরিবের ফারাক। তবেই নিভবে অশান্তির দাবানল। প্রতিটি ঘরে বইবে শান্তির শীতল হাওয়া। স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যাবে পুরো বিশ্বময়। প্রতিজন মানুষ সুখ খুঁইজ্যা পাবে। সুখী হইতে পারবে।