মোঃ আঃ রহিম রেজা,ঝালকাঠি : ঝালকাঠির রাজাপুরের গালুয়া ইউনিয়নের গালুয়া দুর্গাপুর গ্রামের ৩ নং ওয়ার্ডের মৃত সামসু মিরার ছেলে জেলে আবুল বাশার (৫০) ও পুটিয়াখালি গ্রামের ৪ নং ওয়ার্ডের নিম হাওলা এলাকার মৃত ময়নুদ্দিন হাওলাদারের ছেলে জেলে ইউনুচ হাওলাদারের (৪৯) বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জাহাজ ডুবে প্রায় ৪ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে ও সন্ধ্যান না পেয়ে ছোট ছোট শিশু সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ওই দুই পরিবারের সদস্যরা।

জানা গেছে, এ বছরের ২৩ জানুয়ারি শনিাবর ভোররাতে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের ৬৫ নটিক্যাল মাইল উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সময় এফভি যানযাবিল নামের মাছ ধরার জাহাজটি ডুবে যায়। ওই জাহাজে মাছ ধরার জেলে হিসেবে কর্মরত ছিলেন বাসার ও ইউনুচ। জেলে আবুল বাশারের (৫০) স্ত্রী দুলু বেগম জানান, আবুল বাশার একজন পেশায় জেলে। আবুল বাশার বিগত প্রায় ত্রিশ বছর খরে বিভিন্ন জাহাজে চাকুরী করেছেন। সে চট্রোগ্রামের এফভি যানযাবিল নামক ফিসিং জাহাজে এইবার প্রথম চাকুরিতে যোগদান করেন। বিগত দিনে এক একবার গিয়ে ৩/৪ মাস পরে বাড়িতে আসতেন। একমাত্র তার উপার্জন দিয়ে ৫ সন্তানসহ ৭ জনের সংসার চলতো। এবারেও সে ২০২০ সালের আনুমানিক সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ওই জাহাজে যায়। সব সময় তার পরিবারের লোকজনের সাথে মোবাইলে কথা হতো।

২০২১ সালের জানুয়ারী মাসের শুরুর দিকে ফোনে বলেন, আবার চট্টোগ্রাম থেকে সাগরে মাছ ধরতে যাবে এবং সেখান থেকে ফিরে কক্সবাজার হয়ে বাড়িতে আসবেন। ২২ জানুয়ারী শুক্রবার দিনগত রাত সাড়ে দশটার দিকে শেষ কথা হয় আবুল বাশারের সাথে। স্বামী বাশার তাকে তখন জানিয়েছিলেন, সে সাগরে আছেন এবং মাছ ধরছেন। কিন্তু ওই রাতেই তিনটার দিকে এফভি এফভি যানযাবিল নামক ফিসিং জাহাজটি বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে সাগরে ডুবে যায়। প্রথমে এ দুর্ঘটনার খবর অন্য জাহাজের আত্মীয়ের ফোনের মাধ্যমে জানতে পারেন তারা। পরে বিভিন্ন পত্রিকা, টিভির খবরের মাধ্যমে এবং জাহাজের মালিকের সাথে কথা বলে ওই জাহাজটি ডুবে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হন।

এর পর থেকেই অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না। তাদের ৪টি মেয়ে বিয়ে দেয়া হলেও জামাতারা সবাই শ্রমিকের কাজ করছেন। একমাত্র ছেলে তাওহিদ হাসান রাকিবে রাজাপুর সরকারী ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। তার লেখাপড়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাওহীদের আকুতি নিজে বাঁচতে ও মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে একটি চাকুরীর খুবই প্রয়োজন। তাদের পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পরিবারটি দিশেহারা হযে পড়েছেন। তাওহিদ জানান, বাবাকে সেই প্রমত্তা নিষ্ঠুর সাগরে কেড়ে নিয়ে গেছে। তার জীবনে বাবাকে আর ফেরত পাবে না। বাবার ¯েœহমাখা আদর থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলো। লেখাপড়া করে বড় হয়ে চাকরি করবেন এবং মা-বাবার দুঃখ মুছে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফেটাবেন। সে স্বপ্ন যে আর পুরন হবে না। শেষ বারের মতো তার বাবার লাশটিও দেখতে পেলাম না। অপর জেলে ইউনুচ হাওলাদারের (৪৯) স্ত্রী সাথী বেগম জানান, ইউনুচ হাওলাদার এফভি যানযাবিল জাহাজে ২২ বছর চাকুরী করেন। শেষবার জাহাজে গিয়াছে ২০২০ সালের করোনার আগে। করোনার কারনে সে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলোন, করোনা শেষ হলে সে বাড়িতে ফিরে আসবেন। সাথী বেগমের সাথে তার স্বামী ইউনুচ হাওলাদারের শেষ কথা হয় ওই ২২ জানুয়ারী শুক্রবার দিনগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে। পরে জাহাজ ডুবে যাওয়ার খবর পান তারা। সাথী আরো বলেন, ইউনুচ হাওলাদারের উপার্জন দিয়ে ৩ সন্তানসহ ৫ জনের সংসার চলতো। একটি মেয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ২য় সন্তান তামিম হোসেন (১৭) সে শারিরীক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। তারপরেও সে উপজেলার বড়ইয়া ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ৩য় ছেলে রাবেত হাসান তাসিম (১৫)। সে স্থানীয় পঞ্চগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। মেধাবী রাবেত হাসান তাসিমের আশা সে একদিন ডাক্তার হবে। সে ওই বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ইউনুচ হাওলাদারের ইচ্ছাছিলো রাবেতকে ডাক্তারী পড়াবেন। একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটিকে হাড়িয়ে সংসারের সবাই দিশেহারা। হয়তো রাবেত হাসান তাসিমের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আর পুরণ হবে না।

দুলু বেগম ও সাথী বেগম বলেন, ওই জাহাজে ২৬ জন লোক ছিলো। জাহাজ ডুবে যাবার পরে ১৪ জন জীবিত ফিরেছেন, ৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে এবং ৮ জনের আজও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই ৮ জনের মধ্যেই আবুল বাশার ও ইউনুচ হাওলাদার রয়েছেন। তাই তারা আশায় বুক বেধে আছেন। হয়ত তারা ফিরে আসতেও পারেন। অনেক দৌড় ঝাপ করার পরে জাহাজ মলিক মোহাম্মদ আলি পরিবার দুটিকে গত মার্চ মাসে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতি পুরন দিয়েছেন। এ বিষয়ে মোবাইলে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলি উপজেলার জাহাজের মালিক ও কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, আমি খুবই অসুস্থ্য। আমার ম্যনেজারের কাছ থেকে জেনে নিন। ম্যানেজার মোঃ শেখ আহম্মদ জানান, গত ২৩ জানুয়ারী শনিবার ভোররাত ৩ টারদিকে হঠাত সাগরে ঘণ কুয়াশা ও বৈরী আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। সে কারনেই জাহাজটি সাগরে ডুবে যায়। এসময় জাহাজে ২৬জন লোক ছিলো। এদের মধ্যে ১৪ জন জীবিত ফিরে আসেন, ৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে এবং ৮ জন নিখোঁজ হয়েছেন। অনেক খোজা-খুজি করেও তাদের লাশও পাওয়া যায়নি এবং তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও নেই। ওই ক্ষতিগ্রস্থ ১২ টি পরিবারের পাওনা বেতন-ভাতা আলাদা পরিশোধ করে ক্ষতিপুরন হিসাবে প্রত্যেক পরিবারকে ২লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মোক্তার হোসেন বলেন, ওই দুটি পরিবারের খোঁজ নিয়ে সাধ্যমতো সহযোগীতা করার চেষ্টা করা হবে।