সিবিএন ডেস্ক:
অভাবের তাড়নায় বছর পাঁচেক আগে স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে আসেন রেজিয়া বেগম। তাদের একটাই আশা, কষ্ট করে হলেও সন্তানদের লেখাপড়া শেখানো। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার একজনের সাহায্যে কাজও জুটে গেল। একটি তৈরি পোশাক কারখানার হেলপার, বেতন ৩ হাজার টাকা। তারপর ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে হন অপারেটর। এখন বেতন ৮ হাজার টাকা।

নিরাপত্তকর্মী স্বামীর আয়ও প্রায় সমান। সবমিলিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মোট বেতনের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। তার উপর আছে তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। সামান্য আয়ের রেজিয়াদের পাতে মাছ-মাংস উঠে না বললেই চলে। আর ফলমূল তো কেবলই বিলাসিতা।

 

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাই বস্ত্রকন্যা রেজিয়া বলেন, ‘বস্তিতে একটা রুমে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে থাকি। সাত থেকে আটটা পরিবারের জন্য কেবল একটি বাথরুম। রাত ৯-১০টায় ঘরে ফিরে রান্না করে খেয়ে ১২টার আগে ঘুমাতে যাওয়ার উপায় নেই। আবার ভোর ৫টা থেকে লাইন ধরে গোসল, রান্না, খাওয়া সেরে সকাল ৮টার আগে কারখানায় পৌঁছতে হয়। একটু লেট হলেই হাজিরা বোনাস কেটে নেওয়া হয়। অল্প বেতনে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারই জুটে না, পুষ্টিকর খাবার কোথায় পাব?’

দেশে প্রায় ৩২ লাখ নারী কাজ করেন তৈরি পোশাক কারখানায়। ৮০ ভাগেরও বেশি রপ্তানি আয়ে তাদেরই অবদান। মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান ১৪ ভাগের বেশি। অথচ প্রতি ১০ জনের ৮ জনই ভোগেন রক্তস্বল্পতায়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল অ্যাল্যায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (জিএআইএন) গবেষণায় এ ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ নারী শ্রমিকের বয়স ২৩ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে। তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই বিবাহিত। অভিজ্ঞতা বিনিময় করে তারা বলেন, ‘তাদেরকে কারখানার বাইরে নাস্তা খেতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। কেউ যদি কর্তৃপক্ষের কাছে বাইরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়, তখন বলা হয়— প্রচুর কাজ পড়ে আছে, কেন বাইরে যাবে?’

জিএআইএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রক্তস্বল্পতার কারণে নারী শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এতে করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও দেখা দেয় ঘাটতি।

দুই যুগে বেতন বেড়েছে ১৩ গুণ, তবুও অপ্রতুল
শ্রমিকের ঘামেই সচল দেশের অর্থনীতি। শ্রমঘন পোশাক শিল্প সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত। কিন্তু সেই শ্রমিক মুনাফার কতটুকু পায়? তার জীবনের চাকা সচল রাখতে তার মজুরি কি যথেষ্ট? এ খাতের শ্রমিকদের জন্য প্রথম মজুরি ঘোষণা করা হয় ১৯৮৪ সালে। তখন ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬৩০ টাকা।

এক দশক পর ৩০০ বাড়িয়ে করা হয় ৯৩০ টাকা। এর পর প্রায় একযুগ এ খাতে নতুন কোনো বেতন কাঠামো ঘোষণা হয়নি। ২০০৬ সালে অবশ্য ন্যূনতম বেতন হাজারের ঘর স্পর্শ করে, ৯৩০ থেকে বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এর চার বছর পর ২০১০ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা।

২০১৩ সালের জুনে গঠিত মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের মূল বেতন নির্ধারণ করে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ৪ হাজার ১০০, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০, চিকিৎসা ভাতা ৬০০, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ এবং খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। যদিও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে এর বাস্তবতার কোনো মিল নেই।

বস্ত্রকন্যা শিউলি খাতুন বলেন, ‘মাত্র ৭ হাজার ২০০ টাকা বেতন পাই। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামী নিয়ে আমার পরিবার। স্বামীর রোজগারের টাকা চলে যায় বাসা ভাড়ায়। আর আমার আয় দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই। ছেলেদেরও লেখাপড়া শেখাচ্ছি। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে ঠিকমত ডাল-ভাতের ব্যবস্থাও হয় না। অসুখ-বিসুখ হলে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারি না। মাছ-মাংস খাওয়া তো আমাদের কাছে দিবাস্বপ্ন।’

ড. মাহবুব হাসান বাপ্পি অবশ্য বলেন, ‘শুধুমাত্র দামি খাবারই পুষ্টিকর, এমন ধারণা ভুল। আমরা বলছি বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্যের কথা। একজন শ্রমিক প্রতিদিন একই ধরনের খাবার না খেয়ে এতে বৈচিত্র্য আনতে পারেন। যেমন— একদিন তারা লালশাক খেলো, আরেকদিন পুঁইশাক। এতে খাবারে যেমন বৈচিত্র আসবে তেমনি দূর হবে পুষ্টির অভাবও। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ পাওয়া যায়। একেকদিন একেক রকম ছোট মাছেও শ্রমিকদের পুষ্টির অভাব পূরণ হতে পারে।’

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘পোশাক শ্রমিকরা এখন যে মজুরি পায়, তা দিয়ে তারা এবং সন্তানেরা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না। তাই নারী শ্রমিকদের রক্তশূন্যতা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। শুধু এ সমস্যাই নয়, তারা আরও মারাত্মক সব রোগে ভোগেন— কিডনি, শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা ইত্যাদি। এমনকি অতিরিক্ত কাজের চাপে অনেক নারী সন্তানধারণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন।’

তিনি বলেন, ‘৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক পোশাক শ্রমিকের পক্ষে আর কাজ করার শক্তি থাকে না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। তাতে কিছু হলেও তাদের সমস্যাগুলো লাগব হতো।’

এ বিষয়ে পোশাক কারখানার মালিকরা অবশ্য দোষ চাপাচ্ছেন নারী শ্রমিকদের ওপরই। তাদের দাবি, এসব নারী গ্রাম থেকে আসায় তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। এক সময় পোশাককর্মীদের দুপুরের খাবার দেওয়া হতো কারখানায়। এখন তারা খাবার না নিয়ে টাকা নিতে চায়। কিন্তু সেই টাকায় তারা কোনো খাবারই খায় না। ফলে তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের কারণেই এসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা।

দিন দিন কমছে নারী শ্রমিক
নিজের ও পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এ দেশের বেশিরভাগ পোশাকশ্রমিকই দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রম দেন। তবে এ শিল্পে দিন দিনই কমে যাচ্ছে নারীর সংখ্যা। আগে যেখানে ৮০ শতাংশই নারীকর্মী ছিল, এখন তা কমে হয়েছে ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ (বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ)। মূলত প্রযুক্তি ও দক্ষতায় ঘাটতি, পুরুষ শ্রমিক বেড়ে যাওয়া, অপুষ্টি আর নানা ধরনের নির্যাতনের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জলি তালুকদার বলেন, ‘এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জীবনে মজুরিবৈষম্যসহ নানা ধরনের বঞ্চনা, দুর্দশার গল্প। তবে নারী শ্রমিকের বৈষম্য ও বঞ্চনা অপেক্ষাকৃত বেশি। মজুরিবৈষম্য ছাড়াও তারা কারখানার ভেতরে ও বাইরে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। আবার অধিকাংশ নারী শ্রমিকই নিয়োগপত্র পান না, ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তবে এদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই।’

সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারের দাম বেড়েছে
মূল্যস্ফিতি যোগ করলে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে দেশে চালের দাম কমেছে। কিন্তু কয়েকগুণ বেড়ে গেছে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারের দাম। ফলে এগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। এ কারণে দরিদ্ররা ভাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একসময় দেশে পুষ্টির প্রধান উৎস ছিল মাছ। সেই খাবার তো এখন মধ্যভিত্তেরই ধরাছোয়ার বাইরে।

সবজি, দুধ থেকে শুরু করে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারের দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়ায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে পুরো পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে অনেককেই হিমশিম খেতে হয়। আর পরিবারের ব্যয় সংকোচনের ক্ষেত্রে সেই চিরচেনা ভূমিকাতে বরাবরই অবতীর্ণ হন নারী। নানা ব্যয়ভার মেটাতে তারা সমঝোতা করেন নিজের পুষ্টির চাহিদা কিংবা সাধ-আহ্লাদের সঙ্গে।

তবু বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকেরা থেমে নেই। নিত্যদিনের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতাসহ শারীরিক নানা ধরনের রোগব্যাধি; সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনকে মাড়িয়েই তারা শ্রম দিয়ে চলেছেন। নিজেরাই হয়তো জানেন না— তাদের কাঁধে দেশের অর্থনীতির চাকা।