অরক্ষিত ও ঝুঁকিপুর্ণ উপকুলীয় রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ গুলো

মুহাম্মদ মনজুর আলম, চকরিয়া :

আজ ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল। ৩০বছর আগে ১৯৯১সালের এইদিন কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে নেমে আসে প্রলয়লঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব। ১৯৯১ সালে সংগঠিত ঘুর্ণিঝড়ে সবচে বেশি আঘাত হানে কক্সবাজার ও পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে। কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপের উপকূলীয় গ্রামগুলো প্রলয়লঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ে লন্ড ভন্ড হয়ে উপকুলীয় অঞ্চলের মানব সভ্যতা। মৃত্যু ঘটে নানা বয়সের হাজার হাজার মানুষের। সেই সাথে ব্যাপক ক্ষতিসাধন ঘটে গৃহপালিত পশু, মৎস্য সহায় সম্পদ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উপকুলীয় জনপদের জনগণের অন্যতম রক্ষাকবচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ।

ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডবের ক্ষত ইতোমধ্যে ৩০ বছর সময় অতিক্রম করেছে। কিন্তু উপকুলের ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণ এখনো নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার সামাজিক নিরাপত্তা এখনো রয়ে গেছে চরম হুমকির মুখে। বিশেষ করে উপকুলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ সমূহ বছরের পর বছর অরক্ষিত থাকার কারণে এখনো নিশ্চিত হয়নি সামাজিক নিরাপত্তা। বছর ঘুরে ভয়ঙ্কর ২৯ এপ্রিল প্রতিবছর জনগণের সামনে উপস্থিত হলেও এতদিনে ভাগ্য বদল হয়নি এতদাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের। পরিবর্তন হয়নি ক্ষতিগ্রস্থ জনপদের ভগ্নদশার।

চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চলে ঘুর্ণিঝড়ে সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম উৎস হচ্ছে আশ্রয়ন কেন্দ্র। ঘুর্ণিঝড়ের ৩০ বছরে দুই উপজেলায় অদ্যবদি নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয়ন কেন্দ্র। এ দুই উপজেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ এখনো ঘুর্ণিঝড় আতঙ্কে রয়েছেন।

উপকুলীয় জনপদে এখনো বেড়িবাঁধ অরক্ষিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী ও বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অরুপ চক্রবর্তী , কক্সবাজার ও বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২১টিরও বেশী পোল্ডারের অধীন জেলার আট উপজেলায় ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ১৯৯১সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ে উপকুলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অনেক এলাকায় উচুঁ বেড়িবাঁধ মিশে গেছে মাটির সাথে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর অধিক ঝুকিঁপুর্ণ এলাকা চিহিৃত করে প্রাপ্ত অর্থ বরাদ্দের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারে কাজ করছেন। অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের লম্বাখালী ঘোণা এলাকায় তিনটি প্যাকেজে ১১ কিলোমিটারসহ উপকুলের বিপুল এলাকায় নতুন করে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। এবছর পেকুয়াতে বিভিন্ন পোল্ডারে মেরামতের কাজ চলছে ।

নির্বাহী প্রকৌশলীরা বলেন, ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁেধর মধ্যে আমরা ইতোমধ্যে ১৮কিলোমিটার এলাকার বেড়িবাঁধকে অধিক ঝুকিঁর্পুন হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। তারমধ্যে চকরিয়া উপজেলার তিনটি পোল্ডারে ৪ কিলোমিটার এলাকার বেড়িবাঁধ বেশি ঝুকিঁপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে যাতে বেশি ঝুঁিকপুর্ণ ১৮ কিলোমিটার এলাকার বেড়িবাঁধ জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা যায়, সেইজন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে বরাদ্দ চেয়ে পানি উন্নয়ণ বোর্ডের কাছে পরিপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করি বরাদ্দ নিশ্চিত হলে উপকুলের ঝুঁিকপুর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত কাজ সহসা শুরু করা সম্ভব হবে।

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, আশ্রয়ন কে›দ্রের চেয়ে উপকুলীয় অঞ্চলের জনসাধারণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার মুল বলয় হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ও উপকুলীয় বনবিভাগের সৃজিত প্যারাবান।

তিনি আরও বলেন, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অধিক ঝুঁিকপুর্ণ বেড়িবাঁধ গুলো সহসা সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে জনগণের মাঝে আতঙ্কের মাত্রা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে ঘুর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় ১৭টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। চকরিয়া-পেকুয়ায় আগামী বর্ষা মৌসুমে কোন এলাকা যাতে বন্যা এবং জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজও চলছে। বর্তমানে ৩১৫ কোটি টাকা ব্যায়ে বেড়িবাঁধ ও মাতামুহুরী নদী শাসন প্রকল্পের আওতায় কাজ হচ্ছে। সম্প্রতি ৪৬২ কোটি টাকার বরাদ্দে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে মাতামুহুরী নদী শাাসনে আরো একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অনুমতি ক্রমে একনেকে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষ বন্যা থেকে মুক্ত থাকবে। আশাকরি আগামী শুস্ক মৌসুমে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।

অন্যদিকে চকরিয়ায় প্রায় ৩০হাজার একর চিংড়ি চাষের উপযোগী জমি রয়েছে। উক্ত চিংড়িজোনের বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজও চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে চকরিয়ার চিংড়িজোন থেকে উৎপাদিত চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানী করে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে ।

চকরিয়া উপজেলা রেড ক্রিসেন্ট অফিসের তথ্যমতে, ৯১ সালের পর সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থার অনুদানে চকরিয়ায় ৮১টি ও পেকুয়া উপজেলায় ৫৩টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে। দু’উপজেলার জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নেই, তবে বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং সরকারি উদ্যোগে চকরিয়া এবং পেকুয়া দু’ উপজেলায় আরো ১৭টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মিত হয়েছে ।

জানা গেছে, ১৯৯১ সালে সংগঠিত ঘুর্ণিঝড়ে সবচে বেশি আঘাত হানে কক্সবাজার ও পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে। জেলার চকরিয়া, পেকুয়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় গ্রামগুলো প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ে লন্ড ভন্ড হয়ে যায় ।

প্রশাসনের সুত্র সুত্রে জানা গেছে, ঘুর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ ও পূর্নবাসন মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী দেশের ৩৩টি উপজেলাকে সাগর সংলগ্ন বিপদ সংকুলন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে সরকার। এসব উপজেলা গুলোতে পরিকল্পিত ভাবে আশানুরুপ উন্নয়ন কার্যক্রম না হওয়ায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৮৫ লাখ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এখনো। ঘুর্ণিদূর্গত এলাকা সমূহে এখনো নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার। বেড়িবাঁধ গুলোও পুরোপুরি মেরামত বা সংস্কার করা হয়নি বছরের পর বছর ধরে। ফলে এখনো উপকূলীয়বাসী অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।